অর্ঘ্য রায়, ফলতাঃ দীর্ঘদিনের কর্মজীবন শেষ করে অবসর নিচ্ছেন ফলতার শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডল। তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে দক্ষিন চালুুয়ারি নিম্ন বুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হলো এক বর্ণময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফলতা চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক পিয়ালী বড়ুয়া সহ ফলতার অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ।
শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডলের কর্মজীবন ছিল রোমাঞ্চকতায় পরিপূর্ণ। শিক্ষক হওয়ার পূর্বে তিনি ছিলেন সেনা কর্মী সেখানে ভারত মাতার সেবায় সাহসিকতার সাথে শেষ করেছেন একের পর এক অধ্যায়।সেনাবাহিনীতে তার কর্ম জীবন শেষ করার পর ২০০৫ সালে তিনি ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন চালুয়ারি নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে। তখন সেই মুহূর্তে এই বিদ্যালয়ের বেহাল দশা তাকে ভাবিত করে। একটি ছোট চারাগার যেভাবে আসতে আসতে বড় বৃক্ষে পরিণত হয় এই বিদ্যালয়টিও সে ক্ষেত্রে অন্যথা হয়নি। পরিবর্তনের জোয়ার আসে শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডলের হাত ধরে। বিদ্যালয়টি যেমন টালির চাল থেকে ধীরে ধীরে তিন তলা ইমারতে পরিণত হয়েছে সেই সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার মান। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। আলো বাতাস পূর্ণ ক্লাশরুম, সুলভ শৌচালয়,মিটিং হল, ডিসপ্লে বোর্ড, পানীয় জলের নিয়মিত পরীক্ষা, দিনলিপি, আইডেন্টিটি কার্ড, লাইব্রেরী, কম্পিউটার শিক্ষা ও পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী কে তিনি বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সমগ্র বিদ্যালয় কে সিসিটিভি ক্যামেরায় মুড়ে ফেলেন শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডল তারপর থেকে এলাকার বেসরকারি কেজি স্কুল গুলোকে রীতিমত টেক্কা দিয়ে উচু মস্তকে দাঁড়িয়ে রয়েছে চালুয়ারী অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। শুধু তাঁর চোখে একটাই স্বপ্ন ছিল বিদ্যালয়টি যেন ফলতা চক্রের সেরা বিদ্যালয় রূপে পরিগণিত হয়। তাঁর সে স্বপ্ন যে কতটা সার্থক হয়েছে তা এদিনের আমন্ত্রিত শিক্ষক শিক্ষিকা ও এলাকার মানুষদের তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখলে সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
প্রধান শিক্ষকের বিদায় বেলায় স্কুলের কচি-কাঁচারা একে একে শিক্ষককে পুষ্পস্তবক দিয়ে শিক্ষকের পা ছুঁয়ে প্রণাম জানায়। কবিতা পাঠ ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চ ভক্তি-ভালবাসার পূণ্যভূমিতে পরিণত হয়। একে একে বক্তব্য রাখেন শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডলের সহকর্মীবৃন্দ থেকে শুরু করে আমন্ত্রিত অতিথি শিক্ষকবর্গ এলাকার ডাক্তারবাবু,উকিল সহ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও অভিভাবকেরা। প্রত্যেকের কথায় ফুটে ওঠে বিষাদের সুর, হারানোর বেদনা।
ফলতাচক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক পিয়ালী বড়ুয়া বলেন।” স্বপন কুমার মন্ডলের মতো শিক্ষক আমাদের বাংলায় সত্যিই বিরল, যিনি সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার জন্য নানা রকম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তা সত্যিই অনস্বীকার্য। ভবিষ্যতে সরকারের তরফ থেকে আমরা চেষ্টা করব ওনার এই কৃতিত্বের যথাযথ সম্মান দেওয়ার।”
অনুষ্ঠানে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চেয়ারে বসেছিলেন শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডল। তিনি বলেন ” এত ভালোবাসা এত সম্মান পেয়ে তিনি খুবই আপ্লুত। সেইসঙ্গে স্কুল ত্যাগের বেদনা তাকে অনেক বেশি বিদগ্ধ করে তুলেছে। তার হাতে গড়া সন্তান সম এই বিদ্যালয় কে ছেড়ে তাকে থাকতে হবে কোন এক নির্বাসনে যে ভাবনা তাকে আরো ব্যথিত করে তুলছে। তিনি ভাষা হারাচ্ছেন” পরিশেষে বর্তমান স্কুলের পরিচালকমন্ডলী এবং ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকদের তিনি অনুরোধ করেন যাতে তার এতদিনের সংগ্রামে সংগ্রামী হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি যেভাবে বিদ্যালয়টিকে লালন পালন করে এসেছেন তার ধারাকে তারা যেন তারা অখুন্ন রাখেন।
অনুষ্ঠানের পরে এলাকার বাসিন্দা , শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা জোর সওয়াল তোলেন শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডলের এই কৃতিত্বকে সরকারি স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে। তাঁদের দাবি, সামনে আনা হোক স্বপন কুমার মন্ডলের এই কৃতিত্বকে দেওয়া হোক তাকে যোগ্য সম্মাননা। নিরবে যারা সমাজের উন্নয়নের জন্য এভাবে কাজ করে চলেছেন তারা কি চিরকালই প্রচারের আড়ালে থেকে যাবেন? এমন প্রশ্নও ওঠে।