Home General বাঁধ সারাতে ইমারজেন্ট টেন্ডার এ খেলা চলছে নিরন্তর

বাঁধ সারাতে ইমারজেন্ট টেন্ডার এ খেলা চলছে নিরন্তর

0

ওঁকার মিত্র: সত্তর-আশির দশকে সুন্দরবন এলাকার মোসুনী দ্বীপের বাসিন্দা সেচ দফতরের এক ঠিকাদার মাঝে মধ্যেই আলিপুর বার্তার তত্কালীন গোপালনগর অফিসে এসে গোছা গোছা অভিযোগ পত্রের কপি জমা দিতেন আর আবেদন করতেন, আপনারা কাকদ্বীপ সেচ দপ্তরের বাঁধ মেরামতি নিয়ে দুর্নীতি তুলে ধরুন। তাঁর অভিযোগ ছিল মূলত দুটি। এক, সারাবছর কোনো কাজ না করে প্রতিবছর ঠিক বর্ষার আগে ইমারজেন্ট টেন্ডার-এর নামে বেশি রেটে কাজ হয় যা বর্ষা ও কোটালে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। পরের বছর একই জায়গায় ফের ইমারজেন্ট টেন্ডার-এ কাজ হয়। দুই, সুন্দরবন এলাকার ঠিকাদারদের বাদ দিয়ে কাজ দেওয়া হয় বাইরের জেলার ঠিকাদারদের যাদের না আছে এলাকা সম্পর্কে জ্ঞান, না আছে দরদ। ফলে কাজ হয় দায়সারা গোছের। এই দুই দুর্নীতিতে কোটি কোটি টাকার খেলা চলে দপ্তরের গ্রুপ ডি থেকে ইঞ্জিনিয়ার এবং নেতা-মন্ত্রী পর্য ন্ত।
আজ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর পর সুন্দরবনের বাঁধ নির্মান ও মেরামতি নিয়ে একই প্রশ্ন তুললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রমাণ হল, মোসুনীর সেই ঠিকাদারের (বর্তমানে তিনি প্রয়াত) অভিযোগ আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়ে গিয়েছে। এত সংবাদ করেও নেতা-মন্ত্রীদের কানে জল ঢোকানো যায়নি। তফাত্ শুধু একটাই, কোনো অজ্ঞাত কারণে এতদিন নেতা-মন্ত্রীরা যে প্রশ্ন তোলেননি এবার তা সকলের সামনে তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি তিনি তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্য সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা সেচ দপ্তরের এই ঘুঘুর বাসায় আদৌ কোনোদিন তদন্ত শেষ হয়ে দোষী ইঞ্জিনিয়ার ও নেতা-মন্ত্রীদের শাস্তি হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
কেন এই সন্দেহ? আয়লা, বুলবুল, আমফান, ইয়াস দেখিয়ে দিল প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার পরও খড়কুটোর ভেসে যায় বাঁধ অথচ সেচ দপ্তরের ঠিকাদার, কর্মীরা ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক পরিবর্তনেও এই খেলার কোনও উনিশ-বিশ ঘটে না। এই দপ্তরে মন্ত্রী আছেন, সচিব আছেন, দক্ষ ইঞ্জিনিয়াররা আছেন, কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ আছে কিন্তু সুন্দরবনের বাঁধের উন্নতি নেই। সেচ দপ্তর থেকে সদ্য অপসারিত ও বনদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্কালীন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আমফানের পরে সুন্দরবন পরিদর্শনে গিয়ে অবাক হয়ে বলেছিলেন দুহাজার কোটি টাকার বরাদ্দ তিনি অনুমোদন দিয়ে এলেও কেন বাঁধের কাজ হল না তা তাঁর অজানা। অর্থাত্ একজন মন্ত্রী নিজেই বলে দিচ্ছেন অর্থ বরাদ্দ হলেও এখানে কাজ হয় না।
কংগ্রেস, বাম, তণমূল এই তিন আমলের ৭৪ বছরে কত মন্ত্রী সেচ দপ্তরে ঘুরে গিয়েছেন কিন্তু কেউই যে এই ঘুঘুর বাসা ভাঙতে পারেন নি তা সুন্দরবনের বাঁধ প্রতিবছর দেখিয়ে দেয়। কিন্তু সকলেই চোখ বুজে বা চোখ ঘুরিয়ে থাকেন। আজ ১০ বছর পর চোখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাকিয়ে দেখছেন প্রতিবছর টাকা দিয়ে গেলেও আসলে সুন্দরবনের বাঁধ বলে কিছু নেই। সবাই এখানে ভগবানের ভরসায় দিন কাটাচ্ছেন।
সুন্দরবনের আয়তন ৭৯১০ বর্গ কিলোমিটার (৩০৮৯ বর্গমাইল) যার মধ্যে ৪১৭০ বর্গ কিলোমিটার সংরক্ষিত বনভমি। এরই মধ্যে রয়েছে খাঁড়ি-উপখাঁড়ি, বনভমির ছোট ছোট নদী। বাকি ৩৭৪০ বর্গ কিলোমিটার বনহীন অঞ্চলের মধ্যে ২৫৯০ বর্গ কিলোমিটার হল চাষযোগ্য জমি যা ৩৫০০ কিলোমিটার প্রান্তিক বাঁধ দিয়ে ঘেরা। বাকি ১১৫০ বর্গকিলোমিটারের ৮৯১ বর্গকিলোমিটার বসবাসের যোগ্য এবং ২৪৯ বর্গমিটার হল বসবাসহীন তীরভমি বা নতুন করে গজিয়ে ওঠা কিছু নিচু দ্বীপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ব-দ্বীপেই চলে নোনা জলে আর মাটির ঠুনকো বাঁধের ভাঙা গড়ার খেলা। এভাবেই একদিন ২০০৯ সালের ২৫ মে সুপার সাইক্লোন আয়লা এসে দেখিয়ে দেয় সব সময় এই খেলায় জয়ী হয় নোনা জল কারণ যে বাঁধের উপর নির্ভর করে এখানে জীবন বয়ে চলে তা হল দুর্বল, অবহেলিত ও উপেক্ষিত। তাই আয়লার গ্রাসে সম্পূর্ণ ধুয়ে সাফ হয়ে যায় ৫০০ কিলোমিটার নদীবাঁধ ৯,২৬০০০ আধপাকা বাড়ি। নোনাজলে আচ্ছন্ন হয় ৬০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি। তখন ক্ষমতায় বাম সরকার। নড়ে চড়ে বসেন কমরেড নেতারা। ঠিক হয় চওড়া করে নতুন বাঁধ বাঁধা হবে সুন্দরবনে। ৫০৩২ কোটি টাকার প্রকল্প রচনা হয়। শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। এরপর ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তন হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার। গদিতে বসেন কাজের মানুষ জনদরদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ইয়াস আর বুদ্ধপূর্ণিমা এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সবই ছিল রাজনৈতিক নেতাদের জনসেবার অভিনয়। আয়লার পর বুলবুল, আমফান গিয়েছে, সদ্য চলে গেল ইয়াস। প্রতিবছর আসে যায় ভরা কোটাল ও মরা কোটাল। আসবে আরও ঝড়-সাইক্লোন, আসবে টাকা, নিয়োগ হবে ঠিকাদার। কিন্তু আদৌ সুন্দরবনের বাঁধ বদলাবে কিনা তা নির্ভর করবে ঘুঘুর বাসায় আসলে কাদের বাস। তাই সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সেচ দপ্তরের খোল নলচে বদলানো না হলে সুন্দরবনের মানুষের ভবিষ্যত্ বদলাবে না।
সুন্দরবনবাসীর দাবি সেচ দপ্তরে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতিতে এতদিন যেসব ঠিকাদার, কর্মী, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা ও মন্ত্রীরা যুক্ত ছিলেন তাদের আয় বহির্ভত সম্পদের অডিট করা হোক। ঘুষ কাণ্ডে আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সুন্দরবনবাসীর কান্না তাদের কাঁদায় না কেন? কেন তাঁরা সিবিআই-সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেন না বাঁধ তদন্তে? এই প্রশ্নেই লুকিয়ে রয়েছে সুন্দরবনের জীবনের গতিপ্রকৃতি।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version