শক্তি ধর : ভারতীয় গণতন্ত্রের সংখ্যাতত্ত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে কত ভয়ঙ্কর তার নিদর্শন আরও একবার দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজনৈতিক ক্ষমতায় জীবন, জীবিকা, রুজি-রোজগার সহ সবকিছুকে গ্রাস করে নেওয়ার মানসিকতা যে আসলে অস্থিরতার জন্ম দেয় তা বার বার প্রমাণ করেছে এপার বাংলা। বাঙালির ক্রমাবনতি বুঝিয়ে দেয় আগ্রাসী রাজনীতি একটি জাতিকে পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে যে পাঁচটি বছরকে সবচেয়ে কালো অধ্যায় বলে চিহ্নিত করা হয় সেই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ছিল ২৮০টির মধ্যে ২১৬। মেরে কেটে বিরোধীদের সাফ করে দেওয়ার এই সময়কাল বাঙালির কাছে আজও দুঃস্বপ্নের। এর আগে রাজনৈতিক টালমাটালে তিনবার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল এ রাজ্যে। শত দুঃখ-কষ্ট সয়ে বাঙালি ১৯৭৭-এর নির্বাচনে শেষ করে দিল এতদিনের কংগ্রেসী কালচারের। এল নতুন ভোর। ভোরের আলো চড়চড়ে রোদ হতে বেশিদিন লাগেনি। রক্ত পতাকার আড়ালে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের পরিচালনায় গেড়ে বসল নতুন আগ্রানের কৌশল। মেরে ধরে নয়, প্রশাসনের সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে বিরোধীদের দাবিয়ে রাখতে নিজেদের মেধা ও প্রতিভার সাক্ষর রেখে গিয়েছে বাম নেতারা। ২৯৪টি আসনের মধ্যে সিপিএম একাই ১৯৭৭-এ পেয়েছে ১৭৭, ১৯৮২-তে ১৭৪, ১৯৮৭তে ১৮৭, ১৯৯১তে ১৮৮, ১৯৯৬-তে ১৫০ এবং ২০০১-এ ১৪৩টি আসন। ২০০৬ সালে বুদ্ধবাবু যখন আমরা-ওরা তত্ত্ব আওড়াচ্ছেন তখন সিপিএমের আসন সংখ্যা ২৯০-এর মধ্যে ১৭৬। তবুও সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই, ছোট আঙারিয়া সহ শত শত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আটকানো যায়নি। দিন কেটেছে আস্ফালন, হুমকি আর ঔদ্ধত্বে। ফের পিছিয়েছে বাঙালি।
তাই আবার পরিবর্তন। লড়াকু নেত্রীর নেতত্বে দিনবদলের আশা নিয়ে এল কংগ্রেসের বিচ্ছিন্ন অংশ তণমূল কংগ্রেস। বামেদের মতই পর পর তিনটে টার্ম চলছে। বার বার নিরঙ্কুশ সংখ্যা নিয়ে ফিরছে একই সরকার, একই নেতত্ব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বয়ে চলেছে সেই সর্বগ্রাসী ট্রাডিশন। বেশ কিছুটা বে-আব্রু চেহারায়। ভোট আসলে একটাই স্লোগান যেভাবে পারো বিরোধীদের আটকাও। মনোনয়ন আটকাও, ব্যালট আটকাও, পথ আটকাও, অধিকার আটকাও। সব কিছু রাঙিয়ে দাও একটাই রঙে। ফলে ফের বাংলায় শুরু হয়েছে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য। ফের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করেছে বাংলা। খুনোখুনি, মারামারি-কাটাকাটিতে ফের মেতেছে বাঙালি। রামপুরহাটের নৃশংস অগ্নিকান্ডের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে আদালতেও। ইতিমধ্যে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিজে থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে ঘটনার। প্রধানমন্ত্রী সরকারি অনুষ্ঠানে এসেও চেপে রাখতে পারেননি তাঁর প্রতিক্রিয়া। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও ভাষা ফুটছে ক্রমশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নেমে পড়েছে মাঠে। ফের পিছচ্ছে বাঙালি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ফের রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত। চতুর্থবার রাষ্ট্রপতি শাসনের দিকে কী এগোচ্ছে বাংলা? সিঁদুরে মেঘ দেখছে বাঙালি।
ইতিহাসের শিক্ষা বড় নির্মম। সে পাঠ এড়িয়ে গেলেও রক্ষা পাবার উপায় নেই। তাই সেই শিক্ষা দিতে অধর্মকে হারিয়ে ধর্মস্থাপনায় বারবার আসতে হয় ভগবানকে। বাংলা বাঁচাতে এবার অধর্মের আহ্বান ছেড়ে মানবধর্মের চর্চা জরুরি। সকলে মিলে হানাহানি ছেড়ে রাজনৈতিক আগ্রাসনের পথে না হেঁটে রাজ্যের উন্নতিতে কাজ করা জরুরি। আর এর নেতত্ব দিতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকেই। তা না করে অধর্মের পক্ষে দাঁড়ালে পতন যে অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহ নেই। বিপুল সমর্থন কখনও শেষ কথা বলে না বরং ক্ষুদ্র সমর্পণ জয় নিশ্চিত করে। তবে বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করবে না জনগণের পক্ষে দাঁড়াবার বার্তা দেবে তার উপর নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভবিষ্যত।