Home General অসহায় নোনতা গোসাবার চারিদিকে অন্নপূর্ণার আবাহন

অসহায় নোনতা গোসাবার চারিদিকে অন্নপূর্ণার আবাহন

0

ওঁকার মিত্র: বালি আর গোসাবা দুই দ্বীপকে দুভাগ করে বিদ্যাধরীর যে খালটা বয়ে চলেছে তারই বাঁধের উপর দিয়ে দৌড়চ্ছে কিশোরী বউটা। এক হাতে আটপৌরে কাপড়ের অাঁচলের খুট অন্য হাতে ধরা দু-আড়াই বছরের ল্যাংটো ছেলেটা। সেও পাল্লা দিয়ে ছুটছে মায়ের সঙ্গে। চরে ত্রাণবাবুদের নৌকা ভিড়েছে চিঁড়ে-মুড়ি-শুকনো খাবার নিয়ে। কাছাকাছি পাড়ার বউ-ছেলেরা আগেই পেঁছে গিয়েছে সেখানে। তাদের দিয়েই বাবুরা চলে গেলে কিছুই পাবে না সে। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে দেঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এভাবেই বিদ্যাধরী দিয়ে বয়ে চলেছে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের লঞ্চ আর চড়া রোদে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে দুপারের অভুক্ত দ্বীপবাসী। ভেসেছে রান্না করা খাবার নিয়ে বিডিও সাহেবের লঞ্চও। সেখানে সিভিল ডিফেন্সের স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়ে চলেছে ভাত-সবজি-ডিমের ঝোল, যার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন চাল-চুলো হারানো গ্রামবাসী বহুদিন পর দুমুঠো ভাত খাবে বলে। সরকারি বা বেসরকারি সব জলযানই চরে ভিড়ছে নিজেদের ইচ্ছামত। যার যেখানে প্রাণ কাঁদছে সেখানে। বেশিরভাগেরই খাদ্য সামগ্রী ফুরিয়ে যাচ্ছে শেষ প্রান্তে পেঁছাবার আগেই। অবশ্য ব্যতিক্রম সিভিল ডিফেন্সের দৃষ্টি। তাদের খাবার হাজির হচ্ছে দুলকি, সোনাগাঁর মতো প্রান্তিক গ্রামের মাটিতে। সেখানে এবড়ো-খেবড়ো দাওয়ায় বসে অতপ্ত রসনার তপ্তি ঘটাচ্ছেন ছেলে-বুড়ো থেকে গেরস্থ বাড়ির সবাই। গ্রাম পঞ্চায়েত, ভারত সেবাশ্রম, জেলা পুলিশও ক্যাম্প করে বিতরণ করছে রান্না করা খাবার। সেখানেও পাত পড়েছে সারি বেঁধে। টান পড়েছে পানীয় মিঠে জলেও। চোখে পড়ল বাজারের ব্যাগ ফেলে জল নেবার লাইনও। দুমুঠো অন্ন পেটে দিয়ে সোনাগাঁর দেবাশিস ছুটে এল সরকারি আধিকারিকের কাছে বহুদিন ধরে খারাপ হয়ে থাকা তার গ্রামের একমাত্র টিউবওয়েলটা সারিয়ে দেবার আবেদন নিয়ে। অন্নের আকাঙ্খা আর মিঠে জলে তেষ্টা নিয়ে গত ১৫ দিন ধরে এটাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের অন্তর্গত গোসাবা ব্লকের রোজনামচা।
গোসাবা ব্লকের উত্তরে সন্দেশখালি, পশ্চিমে বাসন্তী, পুবে ঘন জঙ্গলের ধার ঘেঁষে রায়মঙ্গল ও কালিন্দি নদীর ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা। দক্ষিণে গহন বাদাবন। ৮টা দ্বীপের ১৪টা গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে এখনকার গোসাবা ব্লক। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫৯৮ জন যার মধ্যে ৭৪ শতাংশের নির্ভর কৃষি ও মত্স্যচাষে। বাদবাকি সাড়ে ২১ শতাংশ জনমজুর বা অন্য পেশায় যুক্ত আর পড়ে থাকা সাড়ে ৪ শতাংশ বেঁচে আছে কুটির শিল্প নিয়ে। কেমন আছে এরা? বিদ্যাধরীর খাল থেকে উঠে গ্রামের মাটিতে পা রাখলেই পাওয়া যাবে এর উত্তর। চৈত্র-বৈশাখের ধান উঠে যাওয়া যে জমিতে এখন ফসল বা বীজতলা বোনার কথা কয়েকদিনের ব্যবধানে তা নোনাজলে জ্বলে পুড়ে রক্তবর্ণ। আক্ষেপ ঝরে পড়ল রাঙাবেলিয়ার বিপিন আর নির্ঝরের গলায়, দেখেছেন জমিগুলো, যেন নোনা রক্ত চুঁইয়ে উঠছে মাটির তলা থেকে। কবে যে তা স্বাভাবিক হবে তা ভগবানই জানেন। তবে বছর দুয়েকের আগে তো নয়ই। এবার কোনরকমে ঘরে মাটি লাগিয়ে বৌ-বাচ্চা ফেলে শহরে গিয়ে বাবুদের কাছে জনমজুর খাটার পালা। একই কথা মত্স্যচাষি মহাদেব, গোকুলদেরও। সমস্ত পুকুর ভাসছে নোনা জলে। পাশ দিয়ে গেলে ভেসে আসছে অাঁশটে পচা গন্ধ। পুকুরের গাছ-গাছালিও পচতে শুরু করেছে। রবি ঠাকুর আর হ্যামিলটন সাহেবের স্মৃতি বিজড়িত শ্যামলিমায় ভরা গোসাবা এখন কাঁদছে নোনা জলের কবল থেকে বাঁচার আশায়।
রোজ খবর আসছে, দুর্গত মানুষদের আশা পূরণে নাকি জোর কাজ চলছে ব্লকে, জেলায়, নবান্নে। সরকারি বাবুরা দলবল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন ত্রাণ দেবার আবেদন সংগ্রহে। ভাঙা বাঁধে বাসা বেঁধেছে জেসিবি। ডায়নোসরের মতো ঘাড়-মাথা ঘুরিয়ে মাটি তুলে ফেলছে বাঁধের উপর। ভাঙা ঘরের চৌচির হওয়া দাওয়ায় বসে সারাদিন দেখা এই দৃশ্য ওলট পালট করে দেয় ভবিষ্যতের ছবিটা। ঘোর ভাঙে বউটার হঠাত্ চঞ্চলতায়। ভেসে যাওয়া উনুন আর ভেজা বিচালির পাশে সন্তান কোলে এতক্ষণ বসে থাকা পরিতোষের বউটা চেঁচিয়ে ওঠে, ওই নৌকা ভিড়েছে, বাবুরা জিনিস দিবে। বউ বেরিয়ে যেতেই সম্বিত্ ফেরা পরিতোষ দাওয়ায় নিয়ে বসিয়ে দুঃখে কঁকিয়ে ওঠে, আয়লার পর ভেবেছিনু এবার বাঁধটা পাকা হবে। হলো নি, গতবারেও মাটি দিল নি ওরা। এবার সব ফুঁসে উঠেছে। ঘৃণার স্বর গলায়, সেচ বাবুদের এলেম জানা আছে। এরই মধ্যে ঘুরে গিয়েছে কেন্দ্রীয় দল, দ্বীপবাসীদের দাবি কংক্রিট বাঁধের। তবে কিছু না বলেই চলে গিয়েছে তারা। জানিনা শেষ পর্যদন্ত কি হবে।
পরিতোষের দাওয়া থেকে উঠতে উঠতে ঢলে পড়েছে সূর্যি। বিদ্যাধরীর চরে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে অন্ধকার। নিভু নিভু বাতির আলো উজ্জ্বল করে কালো পর্দা নেমে আসছে গোসাবার দ্বীপভমি জুড়ে। এগিয়ে আসি রাস্তায় রাখা ভ্যানটার দিকে। পরিতোষ বলে ওঠে, অন্ধকার নামলে অনেকটা স্বস্তি পাই। পুকুর-মাঠের অসহ্য নোনা জলটাকে তো আর দেখতে হয় না। বউটাও ঘরে থাকে। এধার ওধার ছুটে যায় না এটা-ওটা সংগ্রহ করতে। বলতে বলতে ছেলে কোলে তীর বেগে ঘরে ফিরল পরিতোষের বউ। ভ্যানের চাকা গড়াল ঘাটের দিকে। পিছনে পড়ে রইল নোনা গোসাবায় অন্নপূর্ণার আবাহনের সুর।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version