ওঙ্কার মিত্র
বাংলার কবিদের মতো বাংলার রাজনীতিতেও নূতনের ভমিকা অপরিসীম। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় যখনই নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে তখনই নূতন এসে উপস্থিত হয়েছে বারবার। একে পালাবদলই বলুন বা পরিবর্তনই বলুন, সবটাই সাময়িকভাবে ঝড়-বাদল থামালেও আখেরে কিন্তু এই নূতনের আগমণে তেমন কোনো লাভ হয়নি বঙ্গবাসীর। কোনও রকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে বাঙালি কোনও দিনই চায়নি। সম্মান, অধিকার, সংস্কৃতি, বিকল্প ভাবনা বাঙালির সবচেয়ে বড় চাহিদা। তাইতো মাতভমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে বাঙালি। শুধু সম্মান নিয়ে বাঁচার আশায় শরনার্থী হয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছে বাঙালি। সমাজ বদলাবে বলে বিপ্লবের নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাঙালি।
অতীতের সব ঝড় থেমে গিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ধরে যখন সর্বহারা-মেহনতী মানুষের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ব্যাজ সেঁটে ১৯৭৭ সালে নূতন সরকার ক্ষমতায় এল তখন বাঙালি ভাবল এবার সুদিন এসেছে। অচিরেই ভাঙল সে ভুল। মাত্র একটি টার্ম। শুরু নিম্নচাপের ঘূর্ণন। নারকীয় হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, সমাজের সর্বস্তরে রাজনীতিকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে-শিল্পে-কৃষিতে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিম্নচাপকে সাইক্লোনে পরিণত করল। প্রবীনতম মন্ত্রী আখ্যা দিলেন ঠিকাদারদের সরকার। শরিক দলের আর এক মন্ত্রী প্রশ্ন তুললেন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলের সম্পত্তি নিয়ে। মন্ত্রীসভার দু নম্বর মন্ত্রী বললেন চোরেদের সরকার। গ্রামে শহরে স্থানীয় নেতারা ফুলে ফেঁপে উঠলেন দিনের পর দিন। ছড়িয়ে পড়ল সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি, দাদাগিরি। একদিন সর্বহারা নেতারা বুঝে ফেললেন দলে বেনোজল ঢুকেছে। আওড়াতে লাগলেন শুদ্ধিকরণের স্লোগান। কিছুই হল না। নেতারা বুঝেও যেটা বললেন না সেটা হল ততদিনে গলা পর্যন্ত বেনোজলে থৈ থৈ করছে দল। সে জল সরাবার ক্ষমতা নেই এতদিন ধরে চোখ বুজে প্রশ্রয় দেওয়া নেতাদের। ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে শুরু হল অন্য খেলা।
মুখ বদলাতে দেওয়া হল নূতনের ডাক। পোশাকি নাম উন্নততর বামফ্রন্ট। সেটা কি, বুঝে ওঠার আগেই ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর স্বাস্থ্যের কারণে জ্যোতি বাবুকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করা হল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। তিনি নাকি একেবারে আলাদা। ঘনঘন কর্মনাশা ধর্মঘটে বিশ্বাস করেন না। ডাক দিলেন কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত। একেবারে আলাদা শাসক বুদ্ধবাবু চান শিল্প প্রসারের মাধ্যমে বিপুল কর্মসংস্থান। টাটা, জিন্ডাল, সালিমদের ঘনঘন আনাগোনা তখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ। নতুন বোতলে পুরনো মদ ভরা চলছে দারুণ উত্সাহে। বামেরা কোনোদিনই ব্যক্তি রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। অথচ তারাই ব্রান্ড বুদ্ধ-এর নামে রাজ্যবাসীকে নূতনের স্বাদ দিতে উঠে পড়ে লাগলেন। মনে হল এতদিনের ভুল ভ্রান্তি সব শুধরে দেবেন সংস্কৃতিবান বুদ্ধবাবু। কিন্তু এসব যে নেহাতই মুর্খামি বুঝিয়ে দিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। সেখানে যে ফুলে ফেঁপে ওঠা স্থানীয় নেতারা তলে তলে খেলছেন তা বুঝতেই পারলেন না পক্ককেশ তাত্ত্বিক নেতারা। ফলে যা হবার হল, নূতনের ডাক মুখ থুবড়ে পড়ল। বুদ্ধবাবুর আমরা-ওরা দম্ভও তাকে সামাল দিতে পারল না।
বাংলার লড়াকু নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে এল আরও একটা নূতনের ডাক। ২০১১ সালে ক্ষমতায় এল মা-মাটি-মানুষের তণমূল কংগ্রেস সরকার। নতুন নতুন স্বাদ দিতে থাকলেন নেত্রী। সাধারণ জীবন যাপন, সাধারণ বেশভষা, চলা ফেরা, স্থবির প্রশাসনে ধাক্কা দিয়ে মনে কেড়ে নিলেন মানুষের। গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ, ছাত্র ছাত্রীদের জন্য একের পর এক প্রকল্প জনপ্রিয়তার শিখরে পেঁছে দিল নেত্রীকে। প্রথম ধাক্কা এল সারদার হাত ধরে। জড়িয়ে পড়লেন এতদিনের কাছের সঙ্গীরা। নারদ অপারেশনে সরাসরি ঘুষ নিতে দেখা গেল কাছের নেতাদের। নিজের ক্যারিশ্মায় তাও সামাল দিয়েছেন নেত্রী। এত অভিযোগ সত্ত্বেও দু-দুবার ফিরে এসেছেন ক্ষমতায়। কিন্তু ততীয় বার আসার পর ২০২২-এ যে ধাক্কা খাচ্ছে তণমূল সরকার তা সামলানো মুশকিল। কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে চেনা মানুষগুলো। তাই কি ফের সেই মুখ বদলানোর কৌশল। তণমূল কি সত্যি আদি-নব্য দুভাগে বিভক্ত। তাই কি নূতন তণমূল নামে নতুন বোতলের বিজ্ঞাপণ ছড়াচ্ছে শহরে। বহু চর্চিত পোস্টারের আর একটা লাইন তো ভয়ংকর। ঠিক যেমন সাধারণ মানুষ চায়। অর্থাত্ দলের দু নম্বরের ছবি দিয়ে বলেই দেওয়া হচ্ছে বর্তমান সরকারকে সাধারণ মানুষ আর চাইছে না। আজ প্রায় তিন চারদিন হয়ে গেল দু-একটা ছুটকো ছাটকা মন্তব্য ছাড়া দলের পক্ষে এই পোস্টারের বিরোধীতাও কেউ করল না। এমনকি নিষিদ্ধও হল না এই নূতনের ডাক। বিভ্রন্তি ছড়াবার জন্য তিরস্কৃতও হল না পোস্টার দাতারা। তবে কি মেনেই নেওয়া হল ছয় মাসের মধ্যে আসছে নূতন তণমূল। নূতন মুখ। সেই মুখের তলায় কি সেই বামফ্রন্টের কায়দায় সব দুর্নীতি, সব অপরাধ চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যদি তাই হয় তা হবে বাঙালির সঙ্গে আর এক প্রতারণা। কবি বলেছিলেন, হে নূতন দেখা দিক আর-বার। কিন্তু সে নূতন মঙ্গলদায়ক হবে কিনা তা নির্ভর করে নূতনের কাণ্ডারিদের সংযমের উপর। কারণ সেটার উপরই নির্ভর করে ভারতীয় গণতন্ত্রে শাসককে দেওয়া অসীম ক্ষমতার সুশাসন।