Sunday, November 24, 2024
spot_img

ফের সুশাসনের অভাব বাংলার রাজনীতিতে

শক্তি ধর

গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, অযোগ্য শাসনকর্তার চেয়ে দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি আর কেউ করতে পারে না। এই অমোঘ বাণীটি যে কতখানি সত্যি তা বারবার পরখ করার সুযোগ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গবাসীর। শাসনকর্তা মানেই রাজনীতির কারিগর আর রাজনীতি হল বঙ্গের অমরসঙ্গী। ১৯৪৭-এর পর ১৯৬২-র জুলাইতে বিধানচন্দ্র রায়ের জমানা ফুরোতে না ফুরোতেই বঙ্গে উপস্থিত হয়েছিল প্রথম রাষ্ট্রপতি শাসন। সেই বছরের নির্বাচনে ১৫৭টি আসন  পেলেও ক্ষমতা দখল করে বিরোধী জোট। মুখ্যমন্ত্রী হন অজয় মুখার্জী। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে বাংলা দেখেছে চারটি জোট ঘোঁট সরকার ও দ্বিতীয় ও ততীয় রাষ্ট্রপতি শাসন। এই সময় অযোগ্য শাসনের একের পর এক উদাহরণ দেখেছে বঙ্গবাসী। বেকারদের হাহাকার, শ্রমিক নিপীড়ন, খাদ্য সংকট, খুন-জখম, বিশৃঙ্খলায় ভরে গিয়েছিল বাংলার মাটি। অজয়-জ্যোতি চরম দ্বন্দ্বে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল সাধারণ মানুষের। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী নিজেরই বর্বর সরকারের বিরুদ্ধে ধর্ণায় বসেছিলেন ধর্মতলার কার্জন পার্কে। অবশেষে তিনি পদত্যাগ করেন ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ। আর পরদিন ১৭ মার্চ সেই কুখ্যাত দিন যেদিন বামেদের ধর্মঘটের মধ্যে বর্ধমানে ঘটল হাড়হিম করা সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড যার কলঙ্ক আজও বয়ে বেড়াতে হয় সিপিএমকে। আগুনের অাঁচ কমে রাষ্ট্রপতি শাসনে। রাষ্ট্রপতি শাসনের জন্য রাজ্যপাল ধর্মবীরার সুপারিশের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয় সিপিএম। কিন্তু রাজ্যপালের এই সাংবিধানিক কাজে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি আদালত।

১৯৭১ সালের ২৮ জুন থেকে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ পর‌্যন্ত চলা রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান ঘটে ১৯৭২-এর নির্বাচনে। ২৮০টির মধ্যে ২১৬টি আসন জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এল সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কংগ্রেস সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে ১৯৭১-এ ঘটা পাকিস্তান-বাংলাদেশ যুদ্ধের বিজয়িনী নেত্রী এশিয়ার মুক্তি সূর‌্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আশীর্বাদ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাল ধরলেন সিদ্ধার্থবাবু। কিন্তু বাংলার পোড়া কপালে জুটল না যোগ্যতার শাসন। বাংলায় শুরু হল রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের অযোগ্য শাসনে শুরু হল পুলিশী অত্যাচার, নকশাল দমনের নাম করে সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য নির‌্যাতন। নিধন হতে লাগল মেধাবী প্রজন্ম। দেশেও তখন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পরের ইতিহাস আজ সকলের জানা। সেই কালো অধ্যায় আজও পিছু ছাড়েনি বঙ্গ কংগ্রেসের।

এই অরাজকতা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ধুয়ে মুছে গেল কংগ্রেস। বাংলায় এল বামফ্রন্টের শাসন। সেখানেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকের হাতে মরেছে মরিচ ঝাঁপির উদ্বাস্তুরা, আনন্দমার্গীরা। শাসক তার চেনা ঔদ্ধত্যে উড়িয়ে দিয়েছে বানতলার ধর্ষণ, ধানতলার খুন। একে একে অযোগ্য শাসনের চিত্রপটে এসেছে ট্রেজারি কেলেঙ্কারি, অপরাধের ক্লাইম্যাক্সে নানুর, নেতাই, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। এখানেও অজয়-জ্যোতি বিরোধের মতো দেখেছি জ্যোতি-বুদ্ধ বিবাদ। 

দেখা গেছে নিজ সরকারের প্রতি বিনয় চৌধুরীর কটাক্ষকে ফুত্কারে উড়ে যেতে। শেষ দিকে দুটো টার্মে এসেও বাংলার রাজনীতি থেকে আমরা-ওরা-র কলঙ্ক নিয়ে বাংলার রাজনীতি থেকে মুছে গেছেন বুদ্ধবাবু।

১৯১১-র নির্বাচনে ৩৪ বছরের লাল জগদ্দল পাথর ঠেলে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে নতুন ভোরের আলো দেখেছিল বঙ্গবাসী। কিন্তু ভোর সকাল হতেই দেকা যাচ্ছে সেই অযোগ্য শাসনের চড়া রোদ। এতো প্রভু রামের রাম রাজত্ব নয়। দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, অপরাধ মানব শাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু তার সঙ্গে যদি স্বয়ং শাসনকর্তা জড়িয়ে যান তাহলে দেশ ও জাতির সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকে না। শাসকের মুখের বাণী যদি হুমকি ও দুষ্কৃতি প্রশ্রয়ে হারিয়ে যায় তাহলে বাংলার রাহুমুক্তির আশা কম। মাঝে মাঝে মনে হয় ফের সিদ্ধার্থবাবুর জমানা ফিরে নাকি। নিরঙ্কুশ সমর্থনের এই কুত্সিত চিত্কার গ্রাস করে নিচ্ছে শান্তির বাণী। সংবাদ মাধ্যম ও বিচার ব্যবস্থা নামক গণতন্ত্রের দুই স্তম্ভকে নাড়া দিতে শুরু করেছেন বাংলার শাসকরা যা অতীতে বহু শাসককে রাজনীতির নোংরা ডাস্টবিনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে সুশাসনের পতাকা। এখানেও সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে? এখানেও কি এরপর অযোগ্য শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মবীরার মতো সক্রিয় হয়ে উঠবেন রাজ্যপাল? কিন্তু তারপর? অ্যারিস্টটলের সেই যোগ্য শাসনকর্তা কী বঙ্গভমের মাটিতে আবির্ভত হবে?

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

1,231FansLike
10FollowersFollow
4SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles