উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়,সুন্দরবন: আসছে। আবার ও সে আসছে। সব কিছু তছনছ করে দিতে। সঙ্গে টেনে আনছে সাগরের নোনা জলকে। ঝড়ের ঝাপটায় সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে সাগরের জলের ঢেউয়ে সব ডুবিয়ে দিতে চাইছে। যেমনটি ঠিক ১২ বছর আগে আয়লা নামের ঝড় এসে সব কিছু শেষ করে দিয়েছিল। এও আসছে আবার সব কিছু শেষ করে দিতে। আর সেই ধ্বংসের আগাম প্রহর গোণা শুরু করে দিয়েছে সুন্দরবন। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। সুন্দরবনের মানুষের ও সেই অবস্থা। আয়লা, বুলবুল,আমফান আর এবার যশ। কাঁপছে গোটা সুন্দরবনবাসী।গত বছরের আমফানের ভয়াবহ স্মৃতি উসকে এখন যশের আতঙ্কে প্রহর গুনছে সুন্দরবন। আর শুধু সুন্দরবন কেন, উত্কন্ঠার দিন গুনছে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা।২০০৯ সালের ২৬ শে মে আয়লার তাণ্ডবে আর জলোচ্ছ্বাসে এই সুন্দরবনের সব নদী বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকায়। তাঁর জেরে নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছিল বিঘার পর বিঘা কৃষি জমি। ভেঙে গিয়েছিল ঘরবাড়ি।ভেসে গিয়েছিল মিঠে জলের পুকুর, মাছের ভেড়ি। ভিটেমাটি হারিয়ে নিমেশে খোলা আকাশের তলায় ঠাঁই হয়েছিল অনেকের। তাঁর ১১ বছর বাদে গত বছরে হানা দিয়েছিল আমফান। সেই একই ছবি আবারও ফিরে এসেছিল রাতারাতি। ততদিনে নদীবাঁধ কোথাও কোথাও মেরামতি হয়েছিল কোথাও বা হয়নি। সব কিছু হারানো মানুষগুলো ১১ বছর ধরে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু আমফান সেখানে ও ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে। এক বছর পর আবার আরও একটা ঘূর্ণিঝড় আসছে ধেয়ে। বুধবার সকালেই তা আছড়ে পড়বে। আর সেই আতঙ্কেই বুক কাঁপছে সুন্দরবনের বাসিন্দাদের। তাঁরা বলছেন, ‘এই তো সবে একটা মাথা গোজার ঠাঁই তৈরি করে ছিলাম। আবার ঝড় আসছে। কী হবে জানি না।’ সুন্দরবনবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছে প্রশাসন। এলাকায় এলাকায় চলছে মাইকিং। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় কোমর বেঁধে প্রস্তুত জেলা প্রশাসন ও। সোমবার থেকেই সকলকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।গোটা জেলায় মোট ১১৫টি সাইক্লোন সেন্টার ইতিমধ্যেই খুলে দেওয়া হয়েছে। সোমবার থেকেই সেখানে সবাই আসতে শুরু করেছে। তৈরি রাখা হয়েছে জেলার গ্রামীণ এলাকার সব স্কুল বাড়িগুলিকেও। বাঁধের ওপর বসবাসকারীদের উচুঁ জায়গায় কিংবা সাইক্লোন সেন্টারে নিয়ে যাবার কাজ চলছে। সতর্ক রয়েছে উপকূলরক্ষী বাহিনীও। আতঙ্কে দিন কাটছে উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, হাড়োয়া-সহ একাধিক এলাকার মানুষদেরও। যশের সম্ভাব্য অভিমুখ ওড়িশা -ঝাড়খণ্ড উপকূল। তবে যে কোনও মুহুর্তে সে বাঁক নিয়ে হাজির হতে পারে বাংলার বুকে। সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম ধাক্কাই লাগবে দুই ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবনের বুকে।সোমবার দুপুুর থেকে ই দুই ২৪ পরগনা জেলায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা ও রয়েছে। এরপর সময় যতই গড়াবে ততই বাড়বে ঝড়ের বেগ আর বৃষ্টির জোর। ইতিমধ্যেই দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার সাগর, পাথরপ্রতিমা,মৈপীঠ, নামখানা, কাকদ্বীপ, কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হিঙ্গলগঞ্জ ও সন্দেশখালী এলাকায় লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এই সব এলাকার প্রতিটি ব্লক প্রশাসন কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে সেখানকার সব সাইক্লোন শেলটারগুলি প্রস্তুত রাখতে। সঙ্গে চাল, ডাল, ত্রিপল ও খাদ্যপণ্যও সেখানে মজুত করতে। ইতিমধ্যেই ওই সব এলাকার নীচু জমির বাসিন্দাদের সরিয়ে আনা হয়েছে। মত্স্যজীবী দের সমুদ্রে যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছে নবান্ন। প্রশাসনে তরফে ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষকে বলা হচ্ছে, বাড়িতে যেসব খাদ্যশষ্য, প্রয়োজনীয় নথি রয়েছে তা গুছিয়ে রাখুন। এলাকার জলনিকাশী ব্যবস্থা ঠিক রাখুন। পাশাপাশি ঝড় সম্পর্কে সবসময় খবর রাখুন। পরিস্থিতি সেরকম বুঝলে কাছা কাছি ফ্ল্যাড সেন্টারে গিয়ে আশ্রয় নিন।এদিকে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় কলতলি,মৈপীঠ, গোসাবা এলাকায় বাঁধ মেরামতির কাজ চলছে। যশ মোকাবিলায় জেলার মেগা কন্টোল রুুুম খোলা হয়েছে। জেলাশাসক পি উলগানাথন নিজে তা তদারকি করছেন।যশ মোকাবিলায় সব রকমের সহায়তা করে চলেছে প্রশাসন।