সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং : বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন।এই সুন্দরবন নাম নিয়ে বিরাট মত পার্থক্য দেখা যায়। কেউ কেউ বলে থাকেন সুন্দরী গাছের নাম থেকে ‘সুন্দরবন’ নামকরণ হয়েছে। সুন্দরবন নাম নিয়ে মত বিরোধ রয়েছে। যুক্তিবাদীরা না ও মানতে পারেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষকদের স্বীকৃত সত্য ঘটনা হিসাবে রামায়ন,মহাভারত,পূরাণ এর মতামত অনুযায়ী সুন্দরবনের প্রথম নাম ছিল “শাক দ্বীপ” পরে নাম করণ হয় “গঙ্গারিনী”। আরো জানা যায় “পৌন্ড্র বর্ধণ” নাম ছিল। আর বাংলাদেশে “সুগন্ধা” নদীর নাম অনুযায়ী সুন্দরবন নাম করণ হয়।এছাড়াও অনেকেই বলে থাকেন সুন্দরবনের গাছ,নদীনালা জীবন বৈচিত্রের জন্য সুন্দরবন নাম।এনিয়ে বিতর্কের যেমন শেষ নেই, তেমনই “সুন্দরবন দিবস” নিয়ে রয়েছে মতপার্থক্য। সরকারী ভাবে সুন্দরবন উন্নয়ণ পর্ষদের উদ্যোগে ২০১০ সালের ২১ আগষ্ট প্রথম সুন্দরবন দিবস হিসাবে পালন হলে ও পরবর্তীতে ১১ ডিসেম্বর সুন্দরবন দিবস হিসাবে পালন হয়ে আসছে। সুন্দরবনের মোট বনাঞ্চল ১০৮১৩ বর্গ কিমির মধ্যে ৪৭২৬ বর্গ কিমি ভারতীয় ভূখন্ডের,অর্থাৎ সুন্দরবনের ৩৮ শতাংশ ভারতের এবং ৬২ শতাংশ বাংলাদেশের অধীনে। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট(বিশ্ব সম্পদ)” ঘোষনা করেন। এবং একই বছরে ২৯ মার্চ “ম্যান এন্ড বায়োষ্ফিয়ার(জীব পরিমন্ডল)” ঘোষনা হয়। সুন্দরবনের মোট ১০২টি দ্বীপ,এর মধ্যে ৫৪ টি দ্বীপে জনবসতি এবং ৪৮ টি দ্বীপ নিয়ে ম্যানগ্রোভ বন ও বন্যপ্রাণী। উত্তর ২৪ পরগণার জেলার ৬টি ব্লক ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ১৩ টি ব্লক নিয়ে সুন্দরবন। সবথেকে বেশী দ্বীপ রয়েছে পাথরপ্রতিমা ব্লকে ১৩ টি,গোসাবায় ৯ টি,নাখানায় ৫ টি,সন্দেশখালিতে ৬ টি,হাড়োয়া ব্লকে ৫ টি। সুন্দরবনের নদীগুলি লবনাক্ত জলে পরিপুষ্ট। রায়মঙ্গল,হরিণভাঙা,গোসাবা,মাতলা,বিদ্যাধরী,ঝিলা,করতাল,ঠাকুরান,সপ্তমূখী,মুড়ীগঙ্গা,গাবতল,মৃদঙ্গভাঙা,আজমলমারি,ঢুলিভাসানি,চুলকাটি,বেলেডোনা,পিয়ালি,পেইলি,হেড়োভাঙা,মনি,বেনিফেলী,গোমর নদীগুলি জোয়ারের জলে পুষ্ট। ১৫৫৮ সালের ৬ মে থেকে ৩১ জুলাই ২০১৫ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের উপর ২৬ বার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। উল্লেখ্য ১৫৫৮ সালে ৬ মে টানা পাঁচঘন্টা দমকা ঝড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আবার ২৫ মে ২০০৯ সালে আয়লায় ১১০ কিমি বেগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের ৩৫০০কিমি নদী বাঁধের ৭৭৮কিমি নদীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ১৭৮ কিমি নদীবাঁধ পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।এছাড়াও ফণি,বুলবুল,ইয়াস,ডানা’র মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় সুন্দরবনের উপর আছড়ে পড়েছিল।
১৯০৩ সালে উদ্ভিদ বিঞ্জানী ডেভিড প্রেইন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছের উপর গবেষণা করেন। তাঁর তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বের ৫০ টি বৃক্ষজাতীয় ম্যানগ্রোভ রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনে ২৪ টি রয়েছে। এছাড়া ও ১৬৫ টি শৈবাল, ১৩ টি অর্কিড উদ্ভিদ রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্য রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বাসভূমি সুন্দরবনে । সুন্দরী,কাঁকড়া,ধুঁদুল,গরাণ,কেওড়া,গর্জন,কৃপা,তোড়া,ওড়া,পশুর,হেতাল প্রভৃতি গাছ রয়েছে।
রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার,মেছো বিড়াল,বনবিড়াল,হরিণ,শুয়োর,ভোঁদড়,শুশুক,কুমীর,কচ্ছপ,খেঁকশিয়াল,তাড়খেল,স্বর্ণ গোধিকা,বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ কালাচ,কেউটে,এবং বাজ,পেঁচা,নীলকন্ঠ,মোহন চুড়া,শামুখ খোল,গাঙচিল,ডাহুক সহ না প্রজাতির জীবজন্তুর বসবাস সুন্দরবনে।
বৈঞ্জানিকদের দাবী বিশ্ব উষ্ণায়নের কবলে পড়ে সুন্দরবন ধ্বংসের পথে।ফলে সুন্দরবন কে অক্ষত রাখতে পালন করা হয় সুন্দরবন দিবস।পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন কে রক্ষা করার শপথ নিয়ে বুধবার সকালে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ক্যানিংয়ে পালিত হল সুন্দরবন দিবস।
এদিন সকালে ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি উত্তম দাস এর নেতৃত্বে ক্যানিং বাসস্ট্যান্ড থেকে সুন্দরবন বাঁচাও একটি পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। পদযাত্রায় এলাকার কয়েক হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রী সহ এলাকার বিশিষ্টজনেরা অংশ গ্রহণ করেন। পরে মূল অনুষ্ঠানটি ক্যানিং ১ বিডিও অডিটোরিয়াম হলে অনুষ্ঠিত হয়।প্রদীপ প্রজ্জ্বোলনের মধ্যেদিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি উত্তম দাস।উপস্থিত ছিলেন ক্যানিং ১ বিডিও নরোত্তম বিশ্বাস,জেলা পরিষদ সদস্য সুশীল সরদার,ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ প্রদ্যুৎ রায়,পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ অরিত্র বসু,মাতলা ১ পঞ্চায়েত প্রধান হরেন ঘোড়ুই সহ অন্যান্য বিশিষ্টরা। সুন্দরবন দিবস প্রসঙ্গে ক্যানিং ১পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আমাদের তথা দেশের গর্ব সুন্দরবন।সুন্দরবনে জন্মগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে।যাতে করে কোন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন কে বিনষ্ট করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে বৃক্ষনিধন। পরিবর্তে সুন্দরবন কে বাঁচাতে ম্যানগ্রোভ এবং বৃক্ষরোপন করতে হবে।বিশ্ব উষ্ণায়ণ এর কবলে পড়ে সুন্দরবন যাতে ধ্বংস না হয় তারজন্য সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে সুন্দরবন কে রক্ষা করার জন্য। পাশাপাশি বর্জন করতে হবে প্লাস্টিকও।