অমিতাভ সেন
মহাভারতে আছে বিরাট রাজা এক লক্ষ গোদান করেছিলেন। মুদ্রার যখন প্রচলন হয়নি তখন পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে ছিল অর্টিকলস অফ ইউটিলিটি। বিপদে পড়লে এ ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হয়। দেশভাগের সময় অনেকেই বাস্তুভিটে বিনিময় করেছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে স্টেবল স্ট্যান্ডার্ডরাইজসনের বড়োই অভাব। চাণক্য বলেছেন অর্থ ততক্ষণই পূর্ণবল দেয় যতক্ষণ ব্যক্তির অ্যাবসোলিউট কন্ট্রোলে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রিক ও সামাজিক প্রয়োজনে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। অর্জিত অর্থ তখনই মালিক থেকে ব্যাঙ্কের কন্ট্রোলে চলে গেল। অধিকন্তু ব্যাঙ্ক চার্জ করতে পারে। আবার প্রমিসরি নোটের কিছু স্ব-আর্জির সমস্যা আছে। এর ছাপানোর খরচ আছে এবং কারেন্সির লাইফ স্প্যানও বেশি নয়। কোভিড কালে দেখা গেছে এর মাধ্যমে ইনফেকশন ছড়াতে পারে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া জালি নোট। ডিমানিটাইজেশনের সময় পাকিস্তানে ১২ লক্ষ কোটি টাকার জাল কারেন্সি বেকার হয়ে যায়। পাকিস্তানের সরকারী মদতে প্যারালাল ইকনমি ভারতে রফতানি হতো। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মূলে এই জালি নোট। তাই অনেক প্রযুক্তিবিদ ভাবছেন সবই যখন ডিজিটাইজড হয়ে যাচ্ছে পুরনো কারেন্সি কনসেপ্ট এ পড়ে থেকে লাভ কি? অর্থনৈতিক দুনিয়ায় বহু রিয়ল ভ্যালু সমস্যার সমাধান করবে বিট কয়েন- প্রযুক্তিবিদদের এটাই মত।
ট্রাডিশন্যল অর্থনীতিতে টাকা ছাপানো হয় সোনা/রুপার পরিপ্রেক্ষিতে। সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। ক্রিপটো কারেন্সি হলো টাকার ডিজিটাল ফর্ম, এর নিয়ন্ত্রক কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। টাকা অনুভব-স্পর্শযোগ্য ট্রানজেবল অ্যাসেট এবং এর মাধ্যমে অন্য ট্রানজেবল অ্যাসেট কেনা যায়। একাজের লেনদেন ক্রিপ্টোতেও করা যায় তবে কপিউটর মাধ্যমে। এই ট্রান্সজকসন নিয়ন্ত্রণ করে একটা কোড। ক্রিপ্টোর কোনো ফিজিক্যাল ফর্ম নেই। বাস্তব অ্যাকাউন্টেন্সিতে হিসেবরাখার লেজার থাকে। ক্রিপ্টোতে Peer to Peer নেটওয়ার্কে লেজার রাখা হয়, Block Chain পদ্ধতিতে। কোনো লেনদেন হলে (যেমন ক পাঁচটি বিট খ কে দিল) কম্পিউটরের প্রতিটি নোড পয়েন্টে তার রেকর্ড থাকে। কাজেই লেজার একটি নয়, অনেক, কেউ যদি ছেড়ছার করতে চায়, তবে অনেক নোড পয়েন্টে করতে হবে। সেটা প্রায় অসম্ভব। এখন ব্লক চেইন কি। গ্রামে আমি দেখেছি মুদিখানা দোকানে যে হিসেব রাখতো একটা স্লেটে মালের নাম ও পরিমাণ পেনসিল দিয়ে লিখে ওজন করা কর্মচারিকে দিয়ে দিত। শ্লেট/পেন্সিল-এর কাজ যে করে তার নাম ব্লক একটা নির্দিষ্ট ক্যাপাসিটির (1 MB) মেমারি ডিভাইস যা কম্পিটর এ থাকে। প্রতিটি মুহূর্তে হাজার হাজার ট্রানজ্যকসন এর রেকর্ড ব্লক রাখে। একটা স্ল্যাব পূর্ণ হলে আরেকটি আসে। প্রতিট ব্লকের ডাটা একে অপরের সঙ্গে লিংকিং করা থাকে বা চেইন করা থাকে যাতে একটা ব্লকের একটা এন্ট্রির রেফারেন্সের মাধ্যমে অন্য ব্লকের আরেকটা ট্রানজকশনের ডিটেলস জানতে পারা যাবে। একেই বলে ব্লক চেইন সিস্টেম। এতে সমস্ত ব্লক (লেয়ার) পাবলিক ডোমেনে থাকে এবং অ্যাকাউন্টিং ট্রানসপারেন্ট হয়।
যে কোনও ব্যক্তি এক্সচেঞ্জ থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে পারে। এর জন্য ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা বা শেয়ার/স্টক লেনেদেনের জন্য যে ডকুমেন্ট লাগে এ ক্ষেত্রেও তাই। ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগ করলে একটা Key দেওয়া হয়। এই টোকেনও একটা অ্যাসেট, দাম বাড়লে যা বিক্রি করা যায় বা সুদও নেওয়া যায়। বাজারে এজেন্টের কাছেও ক্রিপ্টো কেনা যায়। বিট কয়েন ট্রাস্ট, বিট কয়েন মিউচুয়াল ফান্ডও আছে। ক্রিপ্টো বিক্রি করলে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাঙ্কে চলে আসে। টাকা যেমন আমরা পার্সে রাখি ক্রিপ্টোও ওয়ালেটে রাখা যায়। ওয়ালেট হচ্ছে অনলাইন সফটওয়ার যার মধ্যে প্রাইভেট কী রাখা হয় যা আগে থেকে কোডিং করা হয়। কিছু কিছু এক্সচেঞ্জ এইরকম হট ওয়ালেট ইসু করতে পারে। আবার কোল্ড ওয়ালেটও পাওয়া যায় যা হচ্ছে অফলাইন ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এই এক্সচেঞ্জ গুলি পাউন্ড, ডলারের সাপেক্ষে বিট কয়েন সরবরাহ করে তাকে। আমরা প্লেজিয়ারিজম বলে একটা কথা শুনে থাকি। এর অর্থ অপরের সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত প্রভতির অনুকৃতি বা চুরি করা। ক্রিপ্টো সিস্টেম এইসব কলাকীর্তির সাবেক স্রষ্টাকে একটা সার্টিফিকেট দান করতে পারে যাতে এই ডিজিটাল অ্যাসেট-এর মালিকানা অন্য কেউ দাবি করতে না পারে। এই সার্টিফিকেটকে বলে নন ফানজিবল টোকেন (এনএফটি)-এর মাধ্যমে প্রকৃত সাহিত্যিক/কলাকার তাঁর সৃষ্টির রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত নাও হন এইভাবে ব্লক চেইন পদ্ধতি Intelectual Property Lawএর অনেক সমস্যার সমাধান করেছে। অন্যদিকে দলিল জাল করে সম্পত্তি হড়পে নেওয়া একটা বহুশ্রুত ঘটনা। যদি সম্পত্তির ছবি সহ দলিল ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্লক চেইন-এ রেকর্ড রাখা হয় তবে তা কখনই নকলনবিশী করা সম্ভব হবে না।
সব থেকে বড়ো এবং পুরানো ক্রিপ্টো কারেন্সির নাম বিট কয়েন। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যে বিট কয়েনের দাম ১০০০ ডলার (৭৫০০০ টাকা) ছিল আজ তার দাম ৩৭০০০ ডলার (২৭৭৫০০০ টাকা)। বিট কয়েনকে আজ পর্যন্ত যে কয়টি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে El Salvador প্রথম। এক ক্রেতা ২০১০ সালে পিত্সা কিনতে বিট কয়েন ব্যবহার করেন। তখন দাম ছিল ৪০ ডলার (৩০০০ টাকা)। ক্রেতা পিত্সার জন্য ১০,০০০ বিট কয়েন দেয় যার বর্তমান মূল্য ৩৭০ মিলিয়ন ডলার বা ২৭৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই মরিচিকার প্রলোভনের ফাঁদে পা না দেওয়াই ভালো। প্রথম দিকে বিট কয়েনে ইনভেস্ট করে অনেকেই পয়সা করে নিয়েছে। তবে আজ বোধ হয় ছপ্পর ফোড়কে টাকা আসার দিন শেষ। TESLA কোম্পানির Elon musk ঘোষণা করেছিল বিট কয়েনের বিনিময়ে ইলেক্ট্রিক্যাল গাড়ি কেনা যাবে। বিটকয়েনের দাম উঠলো ৬০,০০০ ডলারে চরে যায়। দুমাস পরে এ প্রস্তাব বাতিল করে। দাম পড়ে যায় ৩০,০০০ ডলার। এই ক্রিপ্টো বাজার ভীষণ Volatile, কোনো কিছুর স্থিরতা নেই। শুধু ভারত সরকার কেন বহু উন্নত দেশ বিটকয়েনকে আইনি স্বীকৃতি দেয়নি। ক্রিপ্টোতে ইনভেস্ট ও লাভ রেকর্ড করা যাবে। কিন্তু ক্রিপ্টো কখনওই লিগাল টেন্ডার নয়। নরমাল কারেন্সি হিসাবে, ব্যবহার করা যাবে না। এবার বাজেটে ২০১৮ সালে আরবিআই সার্কুলার দিয়ে ব্যাঙ্কগুলিকে বলে দেয় ক্রিপ্টো ব্যবসায় সহায়তা করা যাবে না। ২০২০ সালে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট এই অর্ডারকে স্ট্রাইক ডাউন করে দেয়। এবার বাজেটে ভারচুয়াল ডিজিট্যল অ্যাসেটের ওপর ৩০% ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে ক্রিপ্টো লিগ্যলাইজড হলো। কেন্দ্রীয় সরকার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ডিজিট্যল কারেন্সি স্থাপন করেছে। স্বয়ং মোদীজি বলেছেন ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে পড়াশুনো, পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। সব দেশেই কারেন্সির একটা লিমিটেশন আছে। গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাজারে লেনদেন হয় ডলারের মাধ্যমে। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ মানে ঘরে কতো ডলার তুলনীয় ধন আছে। অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে ব্যালেন্স অফ ট্রেড, ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট বহু সমস্যায় প্রতিটি দেশের মুদ্রার মূল্যমান ওঠা নামা করতে পারে। পৃথিবীর সকল দেশ বিবিধ সমস্যার সামনা করতে হতে পারে। কিন্তু আমেরিকার ওপর তার কোনও প্রভাব পড়ে না। কারণ ডলারের তো মূল্যমান পরিবর্তন হয়না। তাই আমেরিকার এতো দাদাগিরি।