নিজস্ব প্রতিনিধি : তোমার জেগে থাকো বলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাই- আপামর দেশবাসীর এমনই কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অতন্দ্র প্রহরীরা। কিন্তু সেই বাহিনীর জওয়ানরাই এখন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। যুদ্ধের আবহে ৬০-এর দশকে সীমান্ত রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভত হয় ভারতবর্ষে। ১৯৬৫ সালের ১ ডিসেম্বর চালু হয় সীমান্তবর্তী বাহিনী বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ। আইন চালু হয় ১৯৬৮ সালে। এই দীর্ঘ সময় ধরে এই বাহিনীর জওয়ানরা অনুপ্রবেশকারী-চোরাচালানকারীর ত্রাস হয়ে উঠলেও কখনও রাজনৈতিক বিরোধিতার বস্তু হয়ে ওঠে নি। ওঠার কথাও নয়, কারণ বিএসএফ জওয়ানদের ধরপাকড় বা তল্লাশির অধিকার থাকলেও আইনি পদক্ষেপ বা শাস্তি দেওয়ার কোন অধিকার নেই। সেই অধিকার রয়েছে পুলিশের যারা রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে। সীমান্তরক্ষীরা শুধু অপরাধী ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ যদি তাদের লঘু কেস দিয়ে ছেড়েও দেয় তবু জওয়ানদের কিছুই করার নেই। আদতে সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী পুলিশেরই একটি সাহায্যকারী বাহিনী যারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করে।
এমন নিধিরাম সর্দারদের নিয়েই রাজনীতির বাজার সম্প্রতি গরম হয়ে উঠেছে। কারণ এদের তল্লাশির এলাকা বাড়ানো হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক নির্দেশে। এতদিন সীমান্ত রেখা থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত তল্লাশির অধিকার ছিল বিএসএফ-এর। এখন তা বেড়ে ৫০ কিলোমিটার। এমন ব্যবস্থা চালু হতে চলেছে তিন সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও পঞ্জাবে। আর এতেই গোঁসা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাবের। তাদের দাবি এই সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের অধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল। এমন কি কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় একটি প্রস্তাবও পাশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়। যা পাঠানো হবে দিল্লিতে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও নাকি এ বিষয়ে নিয়ে দেখা করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। শুধু রাজনৈতিক দেখা সাক্ষাত্ নয়, একটি সাংবিধানিক সংস্থার প্রতি সৌজন্য হারিয়ে রাজ্যের শাসক দলের বিধায়করা অশ্লীল মন্তব্যে বিদ্ধ করেছেন সেই জওয়ানদের, যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের রক্ষা করছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের বিরোধী বিধায়করা।
নিজেদের গায়ে অশ্লীলতার দাগ মুছতে গত ১৭ নভেম্বর এক সাংবাদিক বৈঠকে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলের সোশ্যাল ডিরেক্টর ওয়াই বি খুরানিয়া বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীতে চার হাজারের মত মহিলা প্রহরী রয়েছেন। তাঁদের দ্বারাই মহিলাদের পরীক্ষা করানো হয়। ফলে মহিলাদের শ্লীলতাহানির যে অভিযোগ উঠেছে তা খুবই দুর্দশাজনক। এছাড়া সীমান্তের প্রতিটি প্রবেশ দ্বারে সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। অতএব অত্যাচারের যে দোষ বিএসএফের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে তা অমূলক। অধিকর্তা আরও বলেন, বিএসএফ তল্লাশি করলেও তাদের কোনও আইনি পদক্ষেপের অধিকার নেই। ফলে এলাকা যতই বাড়ুক না কেন তাতে হেনস্থার কোনও প্রশ্নই আসে না।
দুই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে তা আসলে রাজনীতির ইগোর লড়াই বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে প্রশাসনিক প্রয়োজনে এলাকা বা এক্তিয়ারের রদবদল হামেশাই করতে হয় প্রশাসকদের। সবই আসলে দেশ ও দশের প্রয়োজনে। রাজ্য সরকারও পুলিশের এলাকা পুনর্বিন্যাস করে মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে। তাতে ক্ষমতার কম-বেশি হিসাব করার কোনও অবকাশ নেই। পরিস্থিতির প্রয়োজনে মানুষের স্বার্থে পুরো এলাকার ভারও অনেক সময় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে হয়। তাতে যদি পুলিশ গোঁসা করে তাহলে তা বোকামি। শুধু বিএসএফ নয়, সব বাহিনীকেই সমন্বয়ের ভিত্তিতে এলাকায় কাজ করতে হয়। তণমূল স্তরে তা নিয়ে কোনও বিবাদও এতদিন চোখে পড়ে নি। বিএসএফ-পুলিশ চিরকালই মিলে মিশে কাজ করে এসেছে, ভবিষ্যতেও করবে। ফলে বেশি এলাকায় যদি বিএসএফের তল্লাশি চলে তাতে পুলিশেরই মঙ্গল। শুধু শুধু রাজনৈতিক বিতর্কে নেমে জওয়ানদের মনোবল ক্ষুন্ন করার অর্থ অনুপ্রবেশকারী ও চোরাচালানকারীদের উত্সাহিত করা যা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিকদের থেকে কাম্য নয়।