সুভাষ চন্দ্র দাশ ,ক্যানিং –

জটার দেউলকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও সেই কাজ এগোয়নি অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।কবে হবে পর্যটন কেন্দ্র?এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে পাশাপাশি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যে। উল্লেখ্য আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব পালযুগের ইটের তৈরী মিনারটি জটার দেউল। জটাধারী শিবের নাম অনুসারে এই নামকরণ। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মথুরাপুর ব্লকের মনি নদীর তীরে অবস্থিত জটার দেউল।কঙ্কনদিঘীর সন্নিকটে ১১৬নং লটে অবস্থিত ৩০.৪৮ মিটার উঁচু,৯.৩৭মিটার চারপাশে চওড়া টাওয়ারটি খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫ অব্দে রাজা জয় চন্দ্র তৈরী করেছিলেন জটার দেউল।পরে পর্তুগীজ-মগ জলদস্যুরা টাওয়ার হিসাবে ব্যবহার করতো বলে অনেকেরই ধারনা। ১৮৬৮ সালে আবিষ্কৃত হয় রহস্যময় জটার দেউল। অনেকে এটিকে শিব মন্দির মনে করে পূজা-অর্চনা করেন। এই সৌধটির আশে পাশের মাটির তলা থেকে শুঙ্গ-কুষাণ,পর্তুগীজ যুগের মুদ্রা,হাতির দাঁত পাওয়া গিয়েছে।কঙ্কনদিঘী থেকে ব্রাহ্মণ্য ও জৈন দেবদেবীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি পাথরের বুদ্ধমূর্তি,তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবতা,ব্রোঞ্জের তৈরী মহাকাল,বটুক ভৈরব,জম্ভল,ষড়ক্ষরী লোকেশ্বর,কুরুকুল্লা,খাদিরবনি তারা,পোড়া মাটির তৈরী তারামূর্তি,বুদ্ধ মারিচি সহ প্রভৃতি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।নাথ যোগী সম্প্রদায়ের লোকজনেরাই এই মূর্তি গুলো পূজা করতেন।পালযুগে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় শুরু হয় এবং বৌদ্ধধর্ম বাংলা ও বিহারে সংকুচিত হয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্মের মহাযান মতবাদ থেকে তিব্বতি তন্ত্র ও বাংলার তন্ত্রের প্রভাবে বজ্রযান,কালচক্রযান,শূন্যবাদ সহ নানান তান্ত্রিকঐতিহ্য সৃষ্টি হয়। নাথযোগীরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে সপ্তম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে তান্ত্রিক-বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব করেন। আবার ইতিহাসবিদরা মনে করেন সুনির্দিষ্ট ভাবে শুধু যোগী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই লিঙ্গ মূর্তি গুলিকে সংযুক্ত না করে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ ঘরানার এগুলি সংযুক্ত করা উচিত। এই সম্প্রদায়গুলি গুরুবাদী গুহ্য সাধনাচার সহজযান কিংবা সহজিয়াধর্ম নামে পরিচিত ছিল। তাদের সাংকেতিক ধর্মাচরণ চর্যাপদ সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে নাথযোগীরা এই সম্প্রদায়ভুক্ত সহজিয়া সাধক। আদিতে তাঁরা কেবলমাত্র লিঙ্গপূজা করতেন। পরে দেবপাল শাসনের উত্তরকালে যখন এই দেউল নির্মাণ হয় ততদিনে তান্ত্রিক অনুষঙ্গ অনুপ্রবেশ করেছিল এবং তার প্রভাবে লিঙ্গ-অালিঙ্গন মূর্তির প্রচলন ঘটে। ফারফল স্বরূপ জটার দেউলও লিঙ্গ যোনির প্রতিকী রূপদান ঘটেছিল।রহস্যময় জটার দেউল সম্ভবত পাল যুগের শেষ পর্যায়ে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের তৈরী। পরে তাঁরা নাথযোগীতে রুপান্তরিত হয় যায় । বাংলার যোগী সম্প্রদায়ের একটি অংশ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব ঘটিয়েছিল,আবার তাঁরাই একাদশ শতকের কাছাকাছি সময় শৈবধর্মে ফিরে এসে নাথধর্মে প্রবর্তন করে।ফলে  জটার দেউল ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে যে ধর্মের অনুশীলন চলতো তা নাথধর্ম বিকশিত হওয়ার আগেকার ধর্ম ব্রজযান। লিঙ্গ-যোনি অনুষঙ্গ আসলে তন্ত্রসাধনার মূল কথা প্রজনন শক্তির প্রতীক। জটার দেঊলে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকেরা সেই বার্তাই ইঙ্গিতে শিল্পের ছন্দের মাধ্যমে দিতে চেয়েছিলেন। জটার দেউল মন্দিরের মূল উৎস লিঙ্গ মূর্তির পূজা। লিঙ্গ উর্ববতার প্রতীক হয়ে জটাধারী শিবের সাথে মিশে যায়। যার ফলে দেউল মন্দির প্রায়ই শিবমন্দির হতে দেখা যায়।২০১১ সালের শেষ দিকে জটার দেউলের সামনে ক্রম অবতল ঢিবিটিতে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তরফে খনন কার্য শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে একটি ইটের কাঠামো আত্মপ্রকাশ করে । আগে মনে করা হত দেউল সংলগ্ন কোনো নাটমন্দির বা জগমোহন ছিল না। কিন্তু কাঠামোটি আবিষ্কারের পর সেই ধারনা ভুল প্রমানিত হয়। এখনও মনে করা হয় দেউলের সামনে উড়িষ্যার রেখ দেউলের বৈশিষ্টের মতো একটি জগমোহন ছিল। সেই জগমোহনের উপরের আচ্ছাদন ও স্তম্ভগুলি পড়ে গেছে। কালের নিয়মে যার ধ্বংসাবশেষ মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল।মন্দির স্থাপত্যে ভারতের মানচিত্রে জটার দেউল বাংলার এক উল্লেখযোগ্য স্থান। বাংলায় নানান ভৌগলিক কারণে পাথর তেমন সুলভ না হওয়ার পোড়ানো ইট এখানে মন্দির সজ্জার অন্যতম উপকরণ হয়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র বাংলাতে নয় সমগ্র ভারতবর্ষে ইটের তৈরী প্রাচীন দেউল খুবই কম আছে। এখানে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মন্দির সংলগ্ন মেলা বসে। হয় ঘোড় দৌড়ও। এমন একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যময় রহস্যে ঘেরা পুরাকীর্তির ইতিহাস অনন্তকাল বহন করে চলেছে মনিনদী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here