ওঙ্কার মিত্র : স্বাধীনতার পর পণ্ডিত নেহেরু বলেছিলেন দুর্নীতিবাজদের ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে পেটানো হবে। এমন শাস্তি গণতান্ত্রিক সমাজ সমর্থন না করলেও নেহেরুজী আসলে নবীন স্বাধীন ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা কড়া বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নেহেরুজী যখন এসব বলছেন তখন নিশ্চয়ই অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছিলেন এদেশের আমলারা। তাঁরা জানতেন জমিদার-জোতদারদের আমল থেকে দুর্নীতি-স্বজনপোষণের যে বীজ প্রশাসনে মহীরুহ হয়ে শিকড় গজিয়েছে তাকে উত্পাটন করা অত সোজা নয়। বরং রাজারাজরা ও নবাব আমলের দুর্নীতি আর স্বজনপোষণকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গিয়েছে প্রথমে কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ শাসকরা। আর স্বাধীন ভারতের প্রশাসন যখন ব্রিটিশদের ছাঁচেই গড়া তখন স্বচ্ছ ভারতীয় প্রশাসন সোনার পাথরবাটির মতো বস্তু।
আমলাতন্ত্রের সেই ধারণা যে অমূলক নয় ৭৫ বছরে তার প্রমাণ রেখেছে ভারতবর্ষ। আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করার ভার জনপ্রতিনিধিদের উপর দিয়েছিল ভারতীয় গণতন্ত্র। কিন্তু তারা এই নিয়ন্ত্রণের সুযোগে জনগণকে স্বচ্ছ প্রশাসন দেবার বদলে নিজেরাই দুর্নীতি স্বজনপোষণের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে আমলা ও নেতা-মন্ত্রীদের যৌথ অভিযানে একের পর এক দুষ্কর্মের তাণ্ডব চলেছে স্বাধীন ভারতবর্ষে। নেতা, মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের শাসনে রাখবার বদলে নিজেরাই গোছাতে নেমে পড়েছেন খুল্লামখুল্লা। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এক সময় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রশংসিত হয়েছিল। সেটা এখন দুর্নীতি-কাটমানি-স্বজনপোষণের বিকেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার। মজুতদারি, কালোবাজারি, ঘুষ দিয়ে অভিযান শুরু করে এখন ইন্টারনেট, বিমান, জাহাজ, অস্ত্রশস্ত্র সবই এখন দুর্নীতির কবলে। ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৬২ শতাংশের বেশি ভারতীয় কোনো না কোনো সময় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে কোনো একটি কাজ করার জন্য ঘুষ দিয়েছেন। ২০০৮ সালের এক সমীক্ষা বলছে ৫০ শতাংশ ভারতীয়দের ঘুষ দেওয়া বা পাবলিক অফিসের পরিষেবাগুলি পাওয়ার জন্য পরিচিতি ব্যবহার করার প্রথম অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুর্নীতিবাজ ভারতীয় নাগরিকদের কোটি কোটি টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা রাখা এখন জলের মত পরিষ্কার। ২০২১ সালের জুলাই মাসে একটি আরটিআই আবেদনের উত্তরে কেন্দ্রীয় কর বোর্ড জানিয়েছে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তদন্তের পর ভারতে এবং বিদেশে তাদের দ্বারা ২০০৭৮ কোটি টাকার অঘোষিত সম্পদ রয়েছে। আজকে দেখতে পাওয়া পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি এই কালো ভারতবর্ষেরই একটা অংশ। ২০২১ সালের দুর্নীতি সূচকে তাই ভারত ১৮০টি দেশের তালিকায় ৮৫ নম্বর স্থানে।
স্বাধীন ভারতবর্ষ দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রতিনিধিরাই আবার জন্ম দিয়েছেন একের পর এক গোয়েন্দা সংস্থার। ইন্টেলিজেন্স বু্যরো (আইবি), রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র), সেন্ট্রাল বু্যরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই), ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এনআইএ), ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স গ্রিড (ন্যাটগ্রিড), ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড বু্যরো (এনসিআইবি), নারকোটিক কন্ট্রোল বু্যরো (এনসিবি), ডাইরেক্টর অফ রেভেনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই), পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বু্যরো (বিপিআর অ্যান্ড ডি) একের পর এক এসেছে সময় সারণী ধরে। আর্থিক তছরুপ অনিয়ম ধরার জন্য ১৯৭৩ সালে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট (ফেরা) এসেছে, ১৯৭৪ সালে আনা হয়েছে কনজারভেশন অফ ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড প্রিভেনশন অফ স্মাগলিং অ্যাক্টিভিটিস অ্যাক্ট, ১৯৯৯ সালে পাশ হয়েছে ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (ফেমা), ২০০২ সালে লাগু হয়েছে প্রিভেনশন অফ মানি লান্ডারিং অ্যাক্ট (পিএমএলএ), বেশ কিছু অর্থনৈতিক অপরাধী বিনা বাধায় দেশ ছাড়ার পর ২০১৮ সালে এসেছে ফাগিটিভ ইকনমিক অফেন্ডারস অ্যাক্ট (এফইওএ)। শেষোক্ত এই পাঁচটি আইনকে এক সুতোয় গেঁথে অর্থ দফতরের অধীনে তৈরি হয়েছে একটি মালা যার নাম এনফোর্সমেন্ট ডারেক্টরেট বা ইডি। যারা ধরেছে পার্থ-অর্পিতাকে, নিতে চাইছে অনুব্রতকে। এ বড় কঠিন বন্ধন, একবার কেউ এর ফাঁসে আটকালে বেরোনো মুশকিল। তাই বারবার ইডি-র ক্ষমতা খর্ব করার আবেদন জানানো হচ্ছে। সুপ্রীম কোর্ট যা বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীন ভারতের জনপ্রতিনিধিরা আবার জাতে মাতাল তালে ঠিক। তাই মানবাধিকার বজায় রাখতে দেশে তৈরি করেছেন মানবাধিকার কমিশন। নিজেদের অগ্নিপরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে লোক আয়োগ, লোকায়ুক্ত কুন্ড। এত ঢাল-বর্ম-তলোয়ার থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে দুর্নীতির প্রকোপ কমছে না বরং বেড়েই চলেছে। তার একমাত্র কারণ আমলা এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে এরা অসহায়। এই সব দুঁদে গোয়েন্দা সংস্থার সাকসেস রেট নিয়ে আলোচনা করতে বসলে উঠে আসে তীব্র হতাশা। কারণ এদের তৈরি করে প্রাণ দেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু তার প্রাণ ভোমরা বন্দী রয়েছে নির্মাতাদের কুঠুরিতে। আগে এসব প্রশাসনিক চাতুরতায় চাপা ছিল, আজ ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের কল্যাণে সবার সামনে বেরিয়ে পড়েছে সব। তাই তো সমাজের অধঃপতনের মূলে আইএএস-আইপিএসদের প্রকাশ্যে দোষী সাব্যস্ত করলেও তারা এখন মুখে রা কাড়েন না। বরং তারা ছুটে যান গোয়েন্দাদের ডাকে সাড়া দিতে। সুপ্রিম কোর্ট সামান্য পুলিশকে নিরপেক্ষ সংস্থা বানাবার কথা বলেছিল, তাতে কান দেয়নি কোন নেতাই। এদের নিরপেক্ষতা তো দূর অস্ত। তাই হয়তো দিন আসছে নেহেরুজীর সেই আদিম অস্ত্রই একদিন হাতে তুলে নেবে জনগণ। দুর্নীতি দমনে দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মহাজোট স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ার একমাত্র হাতিয়ার।