কমল বন্দ্যোপাধ্যায়: আগস্ট মাস এলেই ১৫ তারিখের আবেগ চালিত দিনটার কথা মনে পড়ে। কিন্তু কোথাও যেন মনের কোণে অখন্ড ভারতের সেই চিত্রটা বার বার মনে পড়ে। যখন লিখছি এই দিনটা হলো ১১ আগস্ট, ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদান দিবস। বার বার মনে পড়ছে আমার কর্মস্থানের সেই ঘরটা। ১৫ আগস্টের দিনটা কাকতালীয়ভাবে ঋষি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের জন্মদিন। আলিপুর কোর্টে আলিপুর বোমা মামলার এবং বরাহনগর বোমা মামলার বিচার কার্য চলেছিল সেই ঘরেই অন্যান্য বহু বিপ্লবীদের সঙ্গে ঋষি অরবিন্দও ছিলেন। কিন্তু তিনি সেখানেই তাঁর সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। প্রায় এক বছর ধরে চলেছিল এই মামলার শুনানি। প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী অবস্থাতেই মোক্ষ লাভ করেন তিনি। ঋষি অরবিন্দের বিপ্লবী থেকে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার বহু ঘটনাই সাক্ষী হয়ে আছে আলিপুর জজ কোর্টের ওই ঘরটি। বহু নথি ব্রিটিশ আমলের রেকর্ড রুমে রয়েছে এবং এই মিউজিয়ামেও স্থান পেয়েছে অনেক কিছুই। ঋষি অরবিন্দের কথা বলতে গেলে প্রামাণ্য কিছু নথির কথা লিখতেই হয়, যা এগুলিকে নিয়ে চর্চা করবার সময় বিভিন্ন ছোটখাটো জায়গা থেকে জানতে পেরেছি।
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ছিলেন এক স্বনামধন্য সাংবাদিক। তখন সন্ধ্যা পত্রিকা বিপ্লবীদের প্রতিবাদের মুখপত্র হিসাবেই বেরতো। শানিত তলোয়ারের মতো শানিত কলমের দ্বারা বিপ্লব আন্দোলনের মুখ্য ভমিকা নিয়েছিল এই পত্রিকা। এই পত্রিকাতেই উপাধ্যায়বাবু কিংসফোর্ডের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী লেখা লিখেছিলেন। কিংসফোর্ড এক কিশোর ছেলেকে রাস্তায় খুব মেরেছিলেন সেটির প্রতিবাদ হিসাবে তিনি তুলে ধরেছিলেন এবং সেই কারণেই তাঁর উপর ব্রিটিশ সরকার একটি মামলা করে। তিনি ১৩ বার ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। যখন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছিল তখন তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশের কোনও কারাগার তাঁকে আটকে রাখতে পারবে না। শেষমেষ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং জেলে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি ইচ্ছামৃতু্য বরণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও তাঁর বোনেরা মিলে প্ল্যানচেট করতেন। এই রকমই একদিন প্ল্যানচেটে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে তাঁরা স্মরণ করেন এবং উপাধ্যায়বাবু বলেন, একজন হতদরিদ্র বিপ্লবী তার নিজের জন্য উকিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং ভালো উকিল খুঁজে পাচ্ছেন না তখন চিত্তরঞ্জন দাসকে উপাধ্যায়বাবু নির্দেশ দেন যেন সে তাঁর মামলাটা নেন। এবং কিছুদিন পরেই কিছু লোক চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং উনি সেই মামলাটি লড়বার জন্য সম্মতি দেন। আসামী পক্ষের সঙ্গে সব উকিলরাই প্রথমে একবার কথা বলে নেয়। উনি সেই মতন জেলে গিয়ে অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করলেন এবং হকচকিয়ে গিয়ে দেখলেন তাঁর সামনে শ্রীকৃষ্ণের অবয়ব। সি আর দাস বুঝলেন এবং অরবিন্দ ঘোষের হয়ে মামলা লড়তে শুরু করলেন। জজ হিসাবে ছিলেন সি পি বেজক্রস আর ইনি আবার ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের বন্ধ।ু যখন তাঁরা বিদেশে পড়াশুনা করতেন। এরপর মামলা চলে প্রায় এক বছর। এবং যখন রায় দান হলো তখন দেখা গেলে শ্রী অরবিন্দ বেকসুর খালাস। অরবিন্দ ঘোষকে ভোর রাত্রে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল ৪৮নং গ্রে স্ট্রিটের বাড়ির দোতলা থেকে। এই রকম বিভিন্ন ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে আলিপুর কোর্টের অলিন্দে অলিন্দে। ট্রায়ালের ওই ঘরটার ইঁট সাক্ষী হয়ে রয়েছে বিপ্লবীদের সাথে ব্রিটিশ সরকারের আইনি যুদ্ধের। আমার কাছে ওই ঘরটি একটি পুণ্যতীর্থ বিপ্লবীদের স্পর্শে পূর্ণতা পেয়েছে। ঘরটিতে ঢুকলেই শিউরে উঠি আমি। এখনকার প্রজন্মের কাছে এই সব ইতিহাস পেঁছয় নি। তার জন্য হয়তো দায়ী থাকব আমরাই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরমের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষকে নিজের মায়ের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে বেঁধে দিয়েছিলেন কিন্তু সেই মায়ের বীর সন্তানদের ইতিহাস কজনই-বা জানতে চায় বা জানতে দিই আমরা। তাই জন্যই হয়তো আজ এতো দেশপ্রেমের অভাব। বিপ্লবীদের বিভিন্ন জিনিসের সম্ভার আলিপুর কোর্টের এই ঘরটিতে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে। কীভাবে হয়েছিল ভারতের পতাকার রূপ পরিকল্পনা। বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পতাকার দেখা মিলবে এখানে। প্রফুল্ল চাকী থেকে শুরু করে আরও বহু বিপ্লবীদের মামলা হয়েছিল এইখানে। সেই সব মামলার বিস্তারিত বিবরণও মেলে এখানে। অখন্ড ভারতের যেখানে যেখানে বিপ্লবীরা বোম মেরেছিল সেইসব বোমের ফর্মুলা ছিল একই। ছোট ছোট বাসের টিকিটের মতো কাগজে লেখা সেই ফর্মুলা বিপ্লবীদের পকেট থেকে মিলেছে যা সংগ্রহিত আছে এখানে। বিপ্লবীরা ধরা পড়লেই তাদের পকেটে মিলত স্বামী বিবেকানন্দের ছবি এবং ছোট ছোট গীতা। তাও সংরক্ষণ করা আছে এখানে। উল্লেখ্য একটি বিষয় খুঁজে পাওয়া গিয়েছে পাহাড় প্রমাণ নথির থেকে তা হলো মহাত্মা গান্ধির লবণ আন্দোলনের আগে বাংলার মাটি থেকে মেদিনীপুরের ৯ জন বিপ্লবী মেদিনীপুরে লবণ আন্দোলন করেছিলেন। তাঁদের ৯ জনকেই পুলিশ নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের সামনে আসেনি বা আনা হয়নি। এই সব ইতিহাসকে চাক্ষুষ করতে আলিপুরের এই মিউজিয়ামটা দেখা খুব প্রয়োজন, জানা খুব প্রয়োজন। বহু বিপ্লবীদের চিঠি এখানে দেখতে পাওয়া যাবে। কারণ, পুলিশ বিপ্লবীদের চিঠি পাঠালেই তা গোপনীয়ভাবে দেখত এবং প্রয়োজন হলে সেগুলো পুলিশের কাছে রেখে দিত। ঋষি অরবিন্দ তাঁর স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি রয়েছে যেখানে তিনি বলছেন, তোমার কাছে কংগ্রেস থেকে অনেকেই যেতে পারে আমাকে কংগ্রেস যোগ দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করাতে কিন্তু জেনে রেখো আমি কোন দিনই কংগ্রেসে যোগদান করবো না। সারা ভারতবর্ষের মধ্যে এখানেই রয়েছে প্রফুল্ল চাকীর মৃতদেহের ছবি। ক্ষুদিরাম বসুর মামলা এখানে না হলেও সেই নথিগুলি এখানে সংগৃহীত আছে এবং তিনি ধরা পড়ার পর বেশ কিছু অরিজিন্যাল ছবি এখানে পাওয়া যায়। এখানে আছে ব্রিটিশ পুলিশের তৈরি করা ১০৫ ফুট লম্বা একটি চার্জশিটের কপি। এই সব বিস্তর জিনিস নিয়ে পড়াশুনো এবং গবেষণা করবার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে কথাও হয়েছে একটি বিল্ডিং তৈরি করার মিউজিয়ামটিকে আরও বিস্তারিতভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য। এবং যুব সমাজ যাতে এগিয়ে এসে এগুলি নিয়ে গবেষণা এবং পড়াশুনো করতে পারে সেজন্য অত্যাধুনিকভাবে তৈরি হবে পড়াশুনো করার জায়গা এবং অন্য দেশ বা অন্য রাজ্য থেকে আসা আগ্রহী গবেষকরা যাতে এখানে থেকে গবেষণা করতে পারে সেজন্য তাদের থাকার জায়গা। জানি না এ স্বপ্ন আমার বাস্তবে পরিণত হবে কি না। কিন্তু না হলে যে ইতিহাস নষ্ট হয়ে যাবে তা আমি বুঝতে পারছি। বিপ্লবীদের কেউ আর কিছু বছর পর মনে রাখতে পারবে না।
লেখক আলিপুর কোর্টের আইনজীবী এবং আলিপুর কোর্ট সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।