ভারতভমিতে সনাতন ধর্মের উপাস্য গঙ্গা নদী। গঙ্গার মতোই পবিত্র জ্ঞান করা হয় সিন্ধু, কাবেরী, নর্মদা নদীগুলিকে। সিন্ধুর অনেকটাই এখন দেশভাগের জন্য বিদেশে চলে গেছে। গঙ্গা নদী আংশিক ভাবে ভাগ হয়ে চলে গেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। তবু ভারতবর্ষে গঙ্গা আজও ভাগের মা হয়নি। ভৌগোলিক ভাবে হিমালয় থেকে গঙ্গাসাগরে পেঁছে গেছে অনেক রাজ্য শহর উপনগরী ও গ্রামকে স্পর্শ করে। বাঁচিয়ে রেখেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে। সনাতন ধর্মে গঙ্গা মহাদেবের জটা থেকে নির্গত হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। এই পবিত্র নদী কোনও দিন কখনও জাতপাতের বিভাজনে অংশগ্রহণ করেনি। সমস্ত জাত ধর্ম ধনী গরিব নির্বিশেষে সকলেরই প্রাণদায়িনী এই স্রোতস্বিনী গঙ্গা। জন্ম থেকে মৃতু্য কিংবা নানা পূজা উপাচারে এই গঙ্গার মাহাত্ম্যই আলাদা। যুগ যুগ ধরে ভারতবাসী গঙ্গার কাছে উপকৃত হয়েছে ও কৃতজ্ঞ থেকেছে।
সাম্প্রতিক কয়েক দশক ধরে গঙ্গাকে দূষিত করার যে প্রবণতা চলছে তা মানব সভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত ভয়ংকর। শিল্পায়ন ও উন্নয়নের ফলেই এমনটা হচ্ছে বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে গঙ্গা নদীকে দিনের পর দিন অবিবেচকের মতো কলুষিত করা হচ্ছে। এর ফলেই ভয়ংকর নদী ভাঙন সমস্যার পাশাপাশি জল ধারণ ক্ষমতা কমে গিয়ে প্লাবনের কারণ হয়ে উঠছে এই নদী। খরস্রোতা গঙ্গাকে কোথাও পরিকল্পনাহীন বাঁধ নির্মাণ করে আটকানো হয়েছে, কোথাও বা শিল্পের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাষণের ক্ষেত্র বানিয়ে তোলা হয়েছে। এক সময় ঢাক ঢোল পিটিয়ে গঙ্গার অ্যাকশন প্লানের কোটি োকটি টাকার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। পবিত্র গঙ্গার বহমানতা বাড়ানোর প্রচেষ্টাও হয়েছিল। তবে তা ছিল সাময়িক। পশ্চিমবঙ্গে আদিগঙ্গা মিলিত হয়েছে ভাগীরথীর সঙ্গে। উন্নয়নের অপরিকল্পিত ভাবনার ধাক্কায় সেই আদি গঙ্গা আজ টালি নালায় রূপান্তরিত হয়েছে। আদি গঙ্গা সংস্কারের অনেক প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে আদি গঙ্গার দূষণ আগামী দিনে কলকাতাবাসীকে আর এক মহামারির সামনে দাঁড় করানোর সম্ভাবনা রয়েই গেছে।
প্রত্যেক দিন আদি গঙ্গা পার্শ্বস্থ বহু বাড়ির পয়ঃপ্রণালীর বর্জ্যপদার্থ সরাসরি আদি গঙ্গায় এসে পড়ছে। এমনকি দিনের পর দিন আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকছে গঙ্গার ঘাট এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে। সৌন্দর্যায়ণের প্রলেপ যখন সারা শহরময় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গঙ্গার প্রতি অবিচার আরও প্রকট হচ্ছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছেই মহাতীর্থ কালীঘাট পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আদিগঙ্গা। হাজার হাজার পূর্ণার্থী আদিগঙ্গায় নিত্য স্নান করছে। অথচ ঢিল ছোড়া দূরত্বেই রাজ রাজেশ্বর ও কাশীশ্বর শিবমন্দির ঘাট দুর্গন্ধ যুক্ত পাঁকে পরিপূর্ণ। প্রাণের ঝুকি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা এবং আগত পুণ্যার্থীরা নদীঘাটে তর্পণ পূজা পার্বন সারে। আদি গঙ্গাকে বাঁচালে আখেরে শহরবাসীর লাভ অল্প বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হতে হয়না কলকাতাবাসীকে। টালিগঞ্জ-গড়িয়া মেট্রো নির্মাণ হয়েছে আদিগঙ্গার বুকের ওপর দিয়ে। আদিগঙ্গা রক্ষার দায়িত্ব সব পক্ষেরই। মাস্টারদা সূর্য সেন কিংবা কবি নজরুল মেট্রো স্টেশনগুলির তলায় যেভাবে মুক্ত আবর্জনার স্তূপ জমা হয় তা আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়।
উত্তরপ্রদেশ বিহার প্রভতি রাজ্য থেকে বহু কোভিড আক্রান্ত মৃতদেহ স্রেফ গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে গঙ্গা পার্শ্বেই অন্ত্যেষ্টি করেছিল। সে দৃশ্য দেখে দেশবাসী চমকে উঠেছিল। স্বচ্ছ ভারত ভাবনার সঙ্গে গঙ্গার স্বচ্ছতাও কাম্য।