Home Global এই মৃত্যুর উপত্যকাই আমার দেশ

এই মৃত্যুর উপত্যকাই আমার দেশ

0

শুভঙ্কর দাস

চারিদিকে চিতার পোড়া কাঠের গন্ধ। বাতাসে দুঃখ। মাটিতে চাপা সহনাগরিকের দেহ। রাত্রির নৈঃশব্দ্য বিদীর্ণ করে ছুটে চলে অ্যাম্বুলেন্স, শববাহী গাড়ি। স্মার্টফোনে বার্তা আসে আপনজনের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর। করোনা থেকেও মানুষ বেশি ভয় পাচ্ছে নিঃসঙ্গতাকে। সে আজকে বেশি উদ্বিগ্ন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থান থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে তৎপর। আদতেই লড়াইটা তাকে একাই করতে হচ্ছে। পাশে আছে সামান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। মৃত্যু, লাশ, শ্মশানের পুড়ে যাওয়া কাঠ, কবরের মাটি যেন বারে বারে বলে চলেছে মনুষ্যত্বের মর্যাদার মৃত্যু হয়েছে। প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য ফিকে করে আর্তনাদ গ্রাস করেছে মননকে। কার পাপে, কার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য আজ এই অবস্থা। এখনো কি আমরা প্রস্তুত। উত্তরটা দিতে হয়তো গলা কেপে উঠবে নীতিনির্ধারকের। তবুও তারা বলে চলবে সব ঠিক আছে। তারা বলবে এবং বলছে ইতিবাচক চিন্তা ধারা মনের মধ্যে আনতে হবে। একদিকে অনাহারের ভীষণ জ্বালা অন্যদিকে মহামারীর হাতছানি। এর মাঝে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। এই আমরা হচ্ছি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সার্বভৌম ভারতের নাগরিক। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার দাদা, বিশ্বগুরু, ভ্যাকসিন গুরু, পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত তার নিজের জনগণকে সামান্য অক্সিজেন, উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা, টিকা দিতে পারছে না। এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে এখনো পর্যন্ত ভারতের নদীগুলিকে স্বর্গের দেব-দেবীর মতন শ্রদ্ধা করা হয়। এই নদীগুলিকে নিয়ে অনেক গল্পকথা, ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী, মিথ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আজ সেই নদীর মধ্যে দিয়েই ভেসে চলেছে মৃতদেহ। যে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা শ্লোক সৃষ্টি করেছিলেন আজ সেই পাড়ে মৃতদেহ চাপা পড়ে রয়েছে। টিকা নেই। চিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জাম রোগীর পরিজনদের করতে হচ্ছে। হাসপাতালে উপচে পড়া অসহায় মানুষের কান্না। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কালোবাজারির প্রকোপ। বেসরকারি হাসপাতালে লাগাম ছাড়া বিল। এত কিছুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে ইতিবাচক ভাবনাগুলি বিদায় নিতে থাকে। এ যেন একটা হেরে যাওয়া যুদ্ধে শুধুই পালিয়ে বেড়ানো। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা বলে চলেছে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ বজায় রেখে করোনা মুখোমুখি হতে। তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করে এই জ্ঞান সকাল-বিকেল টিভি চ্যানেলে দিয়ে চলেছে। ভারতের মতন গরীব দেশে জনগণকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে টাকা দিয়ে টিকা কেনার জন্য। এর সঙ্গেই আবার নীতিনির্ধারকদের সভাসদরা যেমন তারকা ক্রিকেটার, চলচ্চিত্র নক্ষত্র নিজেদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও প্রকাশ করে চাঁদা চাইছে।
এখন গোটা দেশেই লকডাউন চলছে। আর্থিক মন্দার মধ্যেই এই লকডাউনে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে শ্রমজীবী মানুষ, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, ছোট ব্যবসায়ী, হকার, বেসরকারি পরিবহন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। টিকা এখনো সিংহভাগ ভারতীয়ের কাছেও পৌঁছয়নি। যে দেশের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি সেখানে সার্বজনীন টিকাকরণ অভিযান চালানো উচিত ছিল। প্রতিটি বাড়ি, আবাসন, বস্তি, গ্রাম, প্রত্যন্ত গ্রামের কুটিরে গিয়ে টিকাকরণ করলে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যেত। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কার পূর্বপুরুষ ভারতের নাগরিক আর কারা নাগরিক নয় তা দেখতে যদি প্রশাসনিক কর্তারা প্রতিটি বাড়িতে যেতে পারে তবে টিকাকরণের ক্ষেত্রেও তেমনটা হবে না কেন? পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে প্রচার চলাকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে প্রচার চালিয়ে ছিল। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সংশ্লিষ্ট বাড়ি, পাড়া, কলোনীতে গিয়ে নিজেদের কথা বলে এসেছিল। এখন তারা কোথায়? সিপিআইএমের রেড ভলেন্টিয়ার্স কাজ করে চলেছে। বাদবাকি রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এই সদর্থক পদক্ষেপের দেখা মিলছে না।
বেশিরভাগ সরকারি টিকাকরণ কেন্দ্রে ভিড়ের কারণে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। এর ফলে টিকাকরণ কেন্দ্র থেকেই দেখা দিয়েছে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। ফলে সার্বজনীন টিকাকরণ অভিযানের গুরুত্ব অপরিসীম। নীতিনির্ধারকরা বলে চলেছে সংঘবদ্ধভাবে করোনার মোকাবিলা করতে। কিন্তু আদতে মানুষ নিজেকে বড্ড একা মনে করছে। বড্ড নিরুপায় মনে করছে। তাই সে দিল্লির রাজপথে পোস্টার লিখে জানতে চেয়েছে, ” মোদীজি আমাদের শিশুদের ভ্যাকসিন বিদেশে কেন পাঠালেন ? ” গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিক নির্বাচিত প্রধানসেবকের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন করতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন যেন বড্ডও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। পোস্টার টাঙানোর জন্য ২৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারের ক্ষেত্রে যে তৎপরতা প্রশাসনিক কর্তারা দেখিয়েছে সেই একই সক্রিয়তা যদি করোনা রোগীদের আরোগ্যের জন্য নেওয়া হতো তবে সহনাগরিকদের মৃত্যু দেখতে হতো না।
আধুনিক গণতন্ত্রের সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতেই হয়। কিন্তু ভারতে প্রধানমন্ত্রীকে যেন আরাধ্য দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। তার ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক মহলে স্বচ্ছ রাখতে ক্রমাগত সচেষ্ট প্রশাসন। তাইতো করোনায় কতজন আক্রান্ত হচ্ছে, দৈনিক মৃতের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান জানানো হচ্ছে না। সরকারি দাবির সঙ্গে শ্মশানের পরিসংখ্যানের কোন মিল নেই। বিশ্ব ছাড়িয়ে মহাবিশ্বে চলে যাওয়ার স্পর্ধা দেখানো ভারত তার আস্থা এখনো গোমূত্র ও গোবরে দেখিয়ে চলেছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা গোবলয়ে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
চারিদিকে শুধুই দুঃসংবাদ ও হতাশা। রয়েছে পোস্ট কোভিড কম্প্লিকেশনের চোখ রাঙানি। এত কিছুর পরেও জনগণ নিরন্তন সংগ্রামের পথিক। স্রোতস্বিনী গঙ্গার জলে ভেসে যাওয়া স্বজনের মৃতদেহ দেখেও বাকিদের বাঁচানোর স্বার্থে সে উদভ্রান্তের মতো দিগ্বিদিক ছুটে চলেছে। এই ছুটে চলার শেষ কোথায়? এই সীমাহীন মনোকষ্টের ওষুধ কি?নীলাভ আকাশ, শ্বেতশুভ্র হিমালয়, ইতিহাসে চর্চিত, স্থাপত্যে আভিজাত্যে, সমুদ্র ঝঞ্ঝায়, অনন্ত নক্ষত্র মালার আনন্দে আমার দেশ নেই। উন্মুক্ত শ্মশান, ফুটপাতে পড়ে থাকা পিপিই জড়ানো লাশ, কালোবাজারির স্বার্থপরতা, অসাড় হয়ে যাওয়া প্রশাসনিক যন্ত্র, আর্তনাদরত পরিজনের কান্না, বাঁচাতে না পারা চিকিৎসকের মনোবেদনায় এখন আমার দেশ। এই মৃত্যুর উপত্যকা, এই নিঃশ্বাসহীন অব্যক্ত বেদনা আমারই দেশ।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version