শক্তি ধর : বাংলায় এখন নিশি ডাকের আতঙ্ক। ইডি ডাকছে নেতা-মন্ত্রীদের। সিবিআই ডাকছে। এদের সঙ্গে ডাকছে অপরাধীর তালিকায় থাকা রাজনৈতিক কেষ্টবিষ্টু থেকে শুরু করে পুলিশ ও সরকারি আধিকারিকদের। শেষমেশ মধ্যরাতে ডাক পড়েছে এসএসসির উপদেষ্টার- এসো বসো জিজ্ঞাসাবাদে। এ যেন গা ছমছমে ভয়ের কুহেলিকা। কেউ সাড়া দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না। কিন্তু আতঙ্ক কুরে কুরে খাচ্ছে সকলকেই। পাশাপাশি প্রশাসনিক ডাকও আছে। আদালত হলফনামা দিতে ডাকছে সরকারকে। পুলিশ হাজিরা দিতে ডাকছে ইডি আধিকারিকদের। বাদ নেই রাজনৈতিক ডাকেরও। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের শাসক দলের নেত্রী ডাক দিয়েছেন সমস্ত অবিজেপি দলগুলিকে- জোট বাঁধো, তৈরি হও। আর রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ডাকছে কেন্দ্রকে আইনি হস্তক্ষেপের আশায়। সব মিলিয়ে গত দুমাস রাজ্যজুড়ে ডাক-বাংলার ভয় ছড়িয়ে পড়ছে জনমানসে।
দু তরফের এই হাঁক ডাকের মাঝে উলুখাগড়ার মতো কাটা পড়ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আসল সমস্যাগুলো। প্রতিদিন বাড়ছে জ্বালানী তেল, গ্যাসের দাম। গত বছর ১ এপ্রিল পেট্রলের দাম ছিল ৯০.৭৫ টাকা। এবার ১১১ টাকার উপরে। ডিজেল ছিল ৮৭.৭৩ টাকা, এইবছর ছুঁতে চলেছে ৯৬ টাকা। বাড়ির রান্নার গ্যাসের দাম ছিল ৮৩৫.৫০ টাকা, এইবছর আর্থিক বছরের প্রথমে দাম হয়েছে ৯৭৬ টাকা। খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধি গত বছর সেপ্টেম্বরে ছিল ৪.৩৫ শতাংশ, এবছর ফেব্রুয়ারিতে সেটা ৬.০৭ শতাংশ। বলার কেউ নেই। প্রতিবাদে আর উত্তাল হয় না দেশ। সবাই দায়সারা আন্দোলন করে অস্তিত্ব বজায় রাখতে ব্যস্ত। এক কবি বন্ধু অবস্থা বোঝাতে ছন্দ মেলালেন- পাছে ধরে সিবিআই/চেঁচামেচি নাই তাই। আন্দোলন করবে কে? আকন্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে ধরা পড়ার ভয় তাড়া করছে সব সময়।
এই প্রতিবাদহীন আবহে চলছে মানবসম্পদের ধ্বংসলীলা। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় বসে অনশনরত চাকরিপ্রার্থীরা। মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে স্বাস্থ্যকর্মী থেকে মিডডে মিলের নিম্নবেতনে পেট চালানো দায় নিয়ে সহায়করা। পুনর্বাসনের জন্য পথে নেমেছেন প্রস্তাবিত দেউচা-পাঁচামি কয়লা খনি এলাকার বাসিন্দারা। পাথর ব্যবসায়িকদের হাত থেকে তিলাবনি পাহাড় বাঁচাতে পথে নামলেন পুরুলিয়া হুড়া ব্লকের কলাবনি পঞ্চায়েতের গ্রামাবাসীরা। সংগঠিত অপরাধের পর বীরভমের বগটুই গ্রামের বাসিন্দাদের দেখবার কেউ নেই। আতঙ্কে ঘর ছাড়া পুরুষহীন পরিবারের দিন কাটছে গবাদি পশু বেচে খেয়ে। পাহাড়ের বাসিন্দারা পথে নেমেছেন তাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে। ডিএ চেয়ে ক্লান্ত রাজ্যের সরকারি কর্মীরা। স্বাস্থ্যসাথীতে চিকিত্সার বকেয়া মেটাতে হা পিত্যেশ করছে বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম। রেশন নিয়ে প্রতিদিন নয়া ফরমানে পাগলের মতো এদিক ওদিক ছুটছেন সাধারণ মানুষ। চাহিদামতো বরাদ্দ না পেয়ে ভাঙাচোরা পরিকাঠামো নিয়ে ধুঁকছে রাজ্য সরকারি পোষিত স্কুলগুলো। টাকা চেয়ে হয়রান শিক্ষকমশাইয়েরা। ছাত্ররা ঘেরাও করছে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি। অনটনের মধ্যে ধর্ষিতা হয়ে চলেছে জেলার ছোট ছোট মেয়েরা। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে পোষণ অভিযান-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের ১০টি জেলার শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। সমীক্ষা বলছে খোদ কলকাতায় ২৯.৬ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা বাড়েনি। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই সংখ্যা আরও বেশি। অপুষ্টির তালিকায় রয়েছে দার্জিলিং, নদিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানও।
সব মিলিয়ে ১১ বছর পরে পরিবর্তনের সেই মিষ্টি স্বাদ কেমন নোনতা হয়ে এসেছে। গত তিনটি মাস ধরে রাজ্যে চলছে অপরাধ আর তদন্ত সংস্থার বারবাড়ন্ত। উন্নয়নের আলোচনা, পরিকল্পনা চলে গিয়েছে শেষের সারিতে। অথচ যে রাজ্যে বিপুল সমর্থন নিয়ে সরকার ফেরে, অস্ত্বিহীন হয়ে পড়ে বিরোধী শক্তি সে রাজ্যে এমন হওয়ার কথা নয়। তবু হয়, তার কারণ একচ্ছত্র ক্ষমতায় বাসা বাঁধে দুর্নীতি, সংঘাত। দলের সুপ্রিমোকে বলতে হয় আর কাউকে নয়, আমাকে বলো। সব সমাধান আমি করে দেব। এ অসম্ভব ফর্মূলা গণতন্ত্রের ফর্মূলা নয়। বার বার ইতিহাস সেটাই প্রমাণ করেছে।