Home General ইংরেজ আমলের শেষ স্মৃতি লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ী হেরিটেজ ভবন ঘোষিত হলেও সংস্কার না হওয়ায়...

ইংরেজ আমলের শেষ স্মৃতি লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ী হেরিটেজ ভবন ঘোষিত হলেও সংস্কার না হওয়ায় বিলুপ্তীর পথে

0

সুভাষ চন্দ্র দাশ ,ক্যানিং— ১৫৯ বছর আগে সুন্দরবনের খুব কাছেই মাতলা নদীর তীরে অবস্থিত এই বিলাশবহুল বাড়ীটিতে দিন কাটিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ  দম্পতি।ভদ্র মহিলা ছিলেন তৎকালী বিখ্যাত এক চিত্রশিল্পী।তাঁরই শিল্পকলার যাদু আজও শোভা পায় সুদূর ইংল্যান্ড সহ দেশ বিদেশের যাদুঘরে।সেই সময় প্রত্যন্ত এই সুন্দরবন থেকে সুন্দরবনের নদীনালা,প্রাকৃতিক বৈচিত্র সহ গ্রাম বাংলার ছবি এঁকে তাঁর এক বিখ্যাত বান্ধবীকে চিঠি পাঠাতেন।আর সেই বান্ধবী হলেন খোদ রাণি ভিক্টোরিয়া।বিখ্যাত সেই চিত্রশিল্পী ভদ্র মহিলার শ্বশুর ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর স্বামী ছিলেন চার্লস ক্যানিং (লর্ড ক্যানিং)।চিত্রশিল্পী ভদ্রমহিলা হলেন শার্লোটের।

তৎকালীন তাঁর সেই সাধের ঐতিহ্যবাহী বিলাশবহুল বাড়ীটি আজ বিলুপ্তীর পথে!পাশাপাশি শেষ হতে চলেছে ব্রিটিশ ইতিহাসের শেষ স্মৃতির অধ্যায়টিও।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় অশান্ত উত্তেজিত ভারতবর্ষকে শান্ত করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং।বিদ্রোহীদের যেমন কড়া হাতে দমন করেছিলেন তেমনই আবার ভালোবাসাও দিয়েছিলেন।এমন কর্মকান্ডের জন্য তাঁর নাম হয় “ক্লেমেন্সি ক্যানিং”।

উল্লেখ্য এর বেশ কয়েক বছর আগেই ১৮৫৩ সালে সুন্দরবনের দাপুটে নদী বিদ্যাধরী আর মাতলা নদীর সংযোগস্থলে বন্দর গড়ার কথাও চিন্তাভাবনা করেছিলেন।সেই সময় লর্ড ক্যানিং মাতলা ৫৪ নম্বর লটের ৯০০ একর জমি কিনেছিলেন মাত্র ১১ হাজার টাকায়।তাঁরই উদ্যোগে সাধের বাড়ীটিতে তৈরি হয় পোর্ট অফিস।জরিপের জন্য বিলেত থেকে আনা হয় নামিদামি যন্ত্রপাতি এবং বইপত্র।কোন কাজ সেভাবে এগোয় নি।১৮৬১ সালে মারা যান লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রী শার্লোটের(লেডি ক্যানিং)। শোকস্তব্ধ লর্ড ক্যানিং ফিরে যান ইংল্যান্ডে।১৮৬২ সালে তিনিও পরলোক গমন করেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের এটি শহরের পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবনের এই শহরের নামকরণ হয় ক্যানিং।

শতাব্দী প্রাচীন সেই ঐতিহ্যবাহী বিলাশবহুল বাড়ীটি থেকে হারিয়ে গিয়েছে লর্ড ক্যানিংয়ের সেই সব অতীত স্মৃতি।মাতলা নদীর তীরে বিশেষ স্থাপত্য পদ্ধতি অবলম্বন করে তৈরী হয়েছিল দোতলা বাড়ীটি।বিলাশবহুল বিশাল বাড়ীটির সামনে ছিল সিংহদূয়ার,কেয়ারি ফুলের বাগান আর সবুজ ঘাসের লন এবং ওপনিবেশি স্থাপত্যের খিলান যুক্ত।

মাতলা নদীতে জোয়ারের সময় জল বাড়লে সেই জল এই বাড়ীর নীচে খিলান থেকে বেরিয়ে যেত বিশেষ পদ্ধতির জন্য।বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্যানিংয়ে অন্যান্য বাড়ী গুলি ভেঙে পড়লেও আজ অবধি ব্রিটিশ আমলের সর্বশেষ স্মৃতি এই বাড়ীটি ধসে গেলেও ভেঙে পড়েনি।দোতলা এই বাড়ীর মধ্যে ২২ টি ঘরের প্রতিটি ঘরের মধ্যে ছিল ইতিহাস।প্রথম তল থেকে দ্বিতীয় তলে ওঠার জন্য রয়েছে একটি দামী প্রশস্থ কাঠের সিঁড়ি। বর্তমানে সেই ইতিহাস কে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছে।

১৯৬২ সালে ক্যানিংয়ের জয়দেব ঘোষ দম্পতি মুম্বাইয়ের জে এম দাতিয়াল-আরসি কুপার কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নেন।ঘোষ দম্পতির ছেলে বরুণ ঘোষ বিশাল এই বাড়িটি তেমন ভাবে রক্ষণাবেক্ষন করতে সক্ষম হতে পারেননি।জানা যায় এক সময় এই বিলাশবহুল বাড়ীটি হোটেল তৈরী করার জন্য কিনতে চেয়ে জয়দেব ঘোষ কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চিত্রাভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী।আবার সাহারা ইন্ডিয়া গোষ্ঠীও বাড়ীটি কিনতে চেয়েছিল।কিন্তু জয়দেব বাবু বিক্রি করেননি।বিশাল বাড়ীতে বসবাস করতেন জয়দেব ঘোষ ও তার স্ত্রী শিখা ঘোষ। ১৫ টি ঘরের মধ্যে দূর্মূল্য বই,বেলজিয়াম কাঁচের নকশা করা আয়না,মেহগণি কাঠের তৈরী টেবিল,ইংল্যান্ডের লরেন্স অ্যান্ড মেয়ো কোম্পানির টেলিস্কোপ সহ অন্যান্য দামি আসবাব পত্র ১৫ টি ঘরের মধ্যে রেখে তালা মেরে দিয়েছিলেন।পরবর্তী গত প্রায় চার পাঁচ বছর আগে ঘোষ দম্পতি মারা যাওয়ায় বাড়ীটি অভিভাবক হীন হয়ে পড়ে।

অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০০১ এর আইন অনুযায়ী হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষনা করলেও ২০১৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে ঐতিহ্যশালী ভবনের স্বীকৃতি দেয়। যদিও প্রায় চার বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও ভবনটি এখনও অবধি কোন সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি।

সুন্দরবনে বেড়াতে আসা দেশবিদেশের পর্যটকরা আজও ঐতিহাসিক এই ভগ্নব বাড়ীটি দর্শন করে সুন্দরবন ঘুরে যান।

প্রশাসনের অবহেলায় সেই থেকে অবহেলিত শতাব্দী প্রাচীন ইংরেজ আমলের স্মৃতি এই বাড়ীটি বিলুপ্তীর পথে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version