নির্মল গোস্বামী
ধরুন জনস্বার্থে শীর্ষ আদালত মামলাটি গ্রহণ করেছে এবং আমি সেই মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছি
মাননীয় ধর্মাবতার আজকের পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে জনস্বার্থের মামলা গ্রহণ করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ভারতের ১২৫ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে ভারতের সমহান গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরল।
মাননীয় ধর্মাবর্তার আমরা জানি যে, সরকার চলে জনগণের করের টাকায়। আর সরকার তার রাজস্ব আদায় করে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। দেশের জনগণ প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে সরকারকে কর দেয়। সুতরাং পণ্যের উপর কর বসানো সরকারের যেমন কর্তব্য তেমনি জনসাধারণের কর দেওয়াটাও পবিত্র কর্তব্য। সরকার কর চাপিয়েছে এই অজুহাতে জন সাধারণ আন্দোলন করতে পারে। কিন্তু তাই নিয়ে আদালতের দরজার কড়া নাড়াটা বোধহয় আইনসঙ্গত নয় এবং সমীচীনও নয়। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির বিভিন্ন অসংবিধানিক কাজের জন্য প্রায়শই সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। যা একান্তই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত তাতেও হামেশাই ন্যায়ালয়কে পরামর্শ দিতে হয়। পেট্রোপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অমানবিক উদাসীনতাই দায়ী যা সংবেদনশীল সরকারের কর্তব্য নয়। তাই সরকারের ঘুম ভাঙাতে মহামান্য ন্যায়ালয়ের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি ন্যায় বিচারের আসায়। ধর্মাবতার আগেকার যুগে রাজা বা জমিদারগণ প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করত চাবুক মেরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে কিন্তু ২০২১ সালে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষে তদ্রুপ করাটা অসংবিধানিক। ধর্মাবতার পেট্রোপণ্যের উপর সরকার যে পরিরমাণ কর চাপাচ্ছে তা ওই চাবুক মারার সামিল। কারণ অন্যান্য পণ্য যে কেনে তাকেই বাড়তি কর দিতে হয়। যদি কাপড়, টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, মোবাইল, এই সব পণ্যের উপর সরকার কর চাপায়, তাহলে যে কেনে তার উপর প্রভাব পড়ে। কিন্তু পেট্রোপণ্য যারা কেনে না তাকেও বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অথচ তার ইনকাম বাড়ছে না। ধর্মাবতার জমিদার চাবুক মারলে একদিন মার খেত আর এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন মূল্যবৃদ্ধির কশাঘাত খেতে হচ্ছে। ধর্মাবতার পৃথিবীর কোন দেশের সরকারই কোন পণ্যের উপর ১০০% বেশি কর বসায় না। শুধুমাত্র ভারত সরকারই এই নজির স্থাপন করেছে। শুধু যে পেট্রোপণ্যের উপর ১০০% কর আদায় করছে তা নয়, যেহেতু সমস্ত জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে এবং ওই সমস্ত পণ্যের উপর সরকার শতাংশের বিচারে জিএসটি নেয় তাই তা থেকেও সরকারের আয়বৃদ্ধি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গাছেরও খাচ্ছে তলারও কুড়ুচ্ছে।
ধর্মাবতার এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, শেক্সপিয়রের গল্পে সাইলক এন্টানিওর শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস কাটতে চেয়েছিল কিন্তু রক্তপাত হবার কোনও চুক্তি না থাকার জন্য সাইলক তা কাটতে পারেনি। ভারত সরকার ব্যাপারটাও এইরকম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ত কেন্দ্রীয় বাজেটের সময়। রাজ্য সরকার রাজ্য বাজেটে সেস বসাত। তখন বছরে একবার ১ টাকা কি ২ টাকা লিটার বাড়ত। তাতেই দেশে আন্দোলন ধর্মঘট হতো। মানুষ প্রতিবাদ করত। বছরে ১ বার বাড়ালে বাজেট পর্যন্ত একটা সমতা থাকত। ২০১৪ জুলাই থেকে পেট্রোপণ্যের বাজারী স্বাধীনতা দেওয়ার পর থেকে দিন দিন দাম বাড়ছে। ১০, ২০, ২৫, ২৭, ৩০, ৪০ পয়সা করে। এর ফল হচ্ছে ২০/৩০ পয়সা বাড়লে মানুষ মাথা ঘামায় না। বর্তমান বাজার মূল্যে ২০ পয়সা একটা বিড়ি বড়জোর পাওয়া যায়। কিন্তু মাসে দেখা গেল ২-৩ টাকা বেড়ে গেছে। তখন আর কিছুই করার নেই। এই যে প্রতিদিন রক্তক্ষরণ হচ্চে তখন মানুষ বুঝতে পারছে না বা স্বাভাবিক কারণেই গা করছে না। এটা সরকারের এক দুরভিসন্ধি। কারণ তেল কোম্পানিগুলো প্রতিদিন তেল কেনে না। তারা মাসে একবার কি দুবার টেন্ডারে তেল কেনে। যদি বাড়তে হয় তাহলে মাসে একবার বাড়ুক। কিন্তু তাতে মাসে ২/৩ টাকা বাড়াতে গেলে জনগণ ক্ষেপে যাবে। তাই এটা সরকারের একটা সুচতুর গেম প্ল্যান।
ধর্মাবতার সরকারের কাজ হল এমন ভাবে কর অর্থনীতি পরিচালনা করা যাতে বাজারে পণ্যমূল্যের একটা স্থিরতা বজায় থাকে। যা আমাদের আগেকার সরকার করত। এখন প্রতি দিন মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। একদিকে মহামারীতে কোটি কোটি শ্রমিক মজুর কর্মচু্যত দেশে কোটি কোটি বেকার, মানুষের রুটিরুজিতে টান পড়ছে ঠিক সেই সময় এক বছরে প্রায় ২৪ টাকা পেট্রোলে এবং ১৬ টাকা ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি কোন সংবেদশীল সরকারের কি উচিত কাজ? ধর্মাবতার এরা আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছে। তাই যদি হবে তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে একসময় ৩০ ডলার প্রতি ব্যারেলের দাম পড়েছিল। তখন তো বাজারে ৮০ টাকা লিটার পেট্রোল কিনতে হয়েছে কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে কমবে না অথচ বাড়লে বাড়বে এ কি গ্রহণযোগ্য যুক্তি হতে পারে? ধর্মাবতার কোন দলের সরকার সেটা কোনও কথা নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম ১০১ ডলার প্রতি ব্যারেল, তখন একটা ভারত সরকার দেশে ৭৬ টাকা লিটার দরে পেট্রোল বিক্রি করেছে। অথচ আজ আর একটা সেই ভারত সরকার যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ৭৬ ডলার তেলের মূল ব্যারেল প্রতি তখন ভারতের বাজারে ১০৪ টাকা লিটার পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে। এর কি সদুত্তর হতে পারে ধর্মাবতার তা আমার মাথায় ঢোকে না। মাননীয় ধর্মাবতার এক্ষেত্রে আমরা আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলির প্রতি যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখা যাচ্ছে ২০২১এর ১৮ ফেব্রুয়ারি পেট্রোলের দাম যথাক্রমে লিটার প্রতি পাকিস্তানে ৫১.৪৪, শ্রীলঙ্কায় ৬০.২৬টা, বাংলাদেশ ৭৬.৪১টা, নেপাল ৬৮.৯৮ এবং ভটানে ৪৯.৫৬টা। ধর্মাবতার এই দেশগুলির কোনটা পেট্রোলিয়াম উত্পাদনে স্বনির্ভর নয়। প্রত্যেকেই আমদানির উপর নির্ভরশীল। এরা যদি এই দামে পেট্রোল দিতে পারে ভারত কেন পারবে না? মি লর্ড একটা রাজ্য সরকার মেয়েদের হাত খরচা বাবদ বাজেটে দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। অথচ পেট্রোলের উপর সেস কমাচ্ছে না। প্রশ্ন হল সরকারের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলে তবেই তো দান খয়রাতি করবে! দেশের সমস্ত সরকারই এখন দান খয়রাতির মাধ্যমে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরিকরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ধর্মাবতার তেলের দাম কম হলে মানুষ নিজস্ব গাড়ি কিনবে। নতুন গাড়ি মানেই একজন ড্রাইভারের কর্মসংস্থান। গাড়ি বাড়লে সরকারের রোড ট্যাক্স বাড়বে। গ্যারেজে মেকানিক্সদের কাজ আসবে। পরিপূরক শিল্পের বিকাশ ঘটবে। গাড়ির দাম অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে লাখের বেশি টাকা ভ্যাট আসবে সরকারের ঘরে। ধর্মাবতার এটা পরিষ্কার যে পেট্রোপণ্যের দাম কমালে শিল্পের বিকাশ হবে। কর্ম সংস্থান হবে বাজার মূল্য কমবে।
ধর্মাবতার একটা সরকার দেশের সব পণ্যকে জিএসটির আওতায় আনল। তাহলে কেন পেট্রোপণ্যকে আনল না? তার মানে তারা জানে যখন ইচ্ছা হবে তখনই কর চাপাবে। তাই ইচ্ছাকৃত ভাবে পেট্রোপণ্যকে জিএসটির আওতায় তারা আনে নি। জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রে এটা কি নির্ধারণ করা যায় না যে কোন পণ্যের উপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি কর আদায় করতে পারবে না। তা সে যে নামেই হোক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ১৮% বেশি জিএসটি নেই। কিন্তু আমাদের দেশে সর্বোচ্চ জিএসটি হার হল ৩৮%। এটাই সর্ব্বোচ্চ করের সীমা হোক। ধর্মাবতার পরিশেষে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই যে এই মহামারী মোকাবিলার মাঝেও সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা শিল্পকর মুকুব করেছে। কয়েক হাজার কোটি টাকা শিল্পপতিদের অনাদায়ী ব্যাঙ্ক ঋণ মুকুব করেছে। তাহলে প্যান্ডামিক মোকাবিলার জন্য পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে সরকার বাধ্য হচ্ছে এই যুক্তি খাটে কি? ধর্মাবতার সরকার পেট্রোপণ্যের জিএসটির আওতায় আসুক অথবা ভর্তুকি দিয়ে পেট্রোপণ্যের দাম কমাক (ডিজেল ৬০ টাকা ও পেট্রোল ৭০ টাকা) ১২৫ কোটি জনগণের স্বার্থে এটাই আপনার কাছে আমার বিনীত নিবেদন। ধন্যবাদ।