Wednesday, November 13, 2024
spot_img

পয়লা মাঘ চলুন সিংটি গ্ৰামে বৈচিত্রময় ‘কাঁকড়া’ মেলায়

বিঘা বিঘা জমিতে আলু-মটর-সরষে। হলুদ ফুলের শোভা।পরাগ মিলনে ব্যস্ত শতশত সাত রঙা প্রজাপতি।ফুড়ুত ফুড়ুত উড়ে বেড়ায় বেনেবউ, বাঁশপাতির দল।একে ওপরকে তাড়া করে সাদা বক – কালো ফিঙে।কোক কোক ডাকে ডাকপাখি।চটা কল পেতে বসে থাকে বিচ্ছু ছেলের দল।আল ডিঙিয়ে কয়েক বিঘা ধান তোলা জমি। পায়ে লাগে নাড়ার খোঁচা। কিছু জমি সদ্য আলু খোলা।পড়ে থাকা গুড়ি আলু পায়ে দেয় সুড়সুড়ি। জমির মাঝ বরাবর ছাঁদ বাঁধ। ছাঁদ বাঁধের একদিকে ভাই খাঁ-র মাজার।পীর পুকুর।আট দশটি মুসলিম ঘর।হাওড়া হুগলির প্রান্তিক বড় গ্ৰাম সিংটি।পয়লা মাঘ এই সিংটির এই কুড়ি-ত্রিশ বিঘা মাঠ জুড়ে বসে জনপ্রিয় ‘কাঁকড়া ‘ মেলা। কারোর কাছে ‘আলুর দম’ মেলা। কারোর কাছে ভাই খাঁ-র জাত।জনশ্রুতি আছে : প্রায় পাঁচশো বছর আগে আরব দেশ থেকে এক অজ্ঞাত পরিবারের সাত ভাই ও এক বোন কোন কারণে বঙ্গদেশে চলে আসেন।এরা কলকাতা- হাওড়া- হুগলি ও বর্ধমান জেলার কয়েকটি স্থানে বসবাস শুরু করেন।বোন ফাতেমাকে নিয়ে ভাই খাঁ বাস করতেন হাওড়া উদয়নারায়ণপুরের সিংটি গ্ৰামে।ভাই খাঁ-র আসল নাম কেউ জানে না। খেলার সাথীরা ভাই ভাই বলে ডাকে। সেই থেকেই ভাই খাঁ।ছোট বেলা থেকেই ভাই খাঁ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ ও নানা রোগ ব্যাধির উপশমে ভাই খাঁ ক্ষ্যাতি লাভ করেন।জানা যায় বর্ধমানের মহারাজা একবার ভাই খাঁ-র দ্বারা উপকৃত হন।সাদা মাঠা ভাই খাঁ-র মাজার। মাজারের দুটি অংশ। একটিতে ভাই খা-র সমাধি। অপরটিতে তার দুই শিষ্য সইফ আলি খাঁ ও গোপাল খাঁ-র সমাধি। পাশেই বোন ফাতেমা বিবির মাজার।পয়লা মাঘ প্রয়াত হন ভাই খাঁ।লোকশ্রুতি আছে মৃত্যুর আগে নাকি ভাই খাঁ তার শিষ্যদের নিজের মৃত্যুর দিন জানিয়ে দেন। সেই মতো দূর দূরান্ত থেকে শিষ্যরা পৌষ সংক্রান্তির দিন দলে দলে হাজির হন। সেই রাতে শিষ্যদের তিনি মেলা প্রবর্তনের আদেশ দেন। তারপর ভাই খাঁ দেহত্যাগ করেন। সেই থেকে পয়লা মাঘ চালু হয় ভাই খাঁ-র জাত।লোকশ্রুতি যাই থাক। মেলাটি মজাদার। জমজমাট। আকর্ষণীয়।মেলায় মূলত বিক্রি হয় ছিপ,হুইল, কোঁচ, পলো,বিন্তি। দেদার বিক্রি হয় মাছ ধরার ঘুনি,প্যাং,চুনো জাল,টানা জাল,বেড়া জাল,বিন জাল,পাতি ও খেপলা জাল।পাওয়া যায় ঝুড়ি, ঝাঁকা,চুপড়ি,টুকরি।বাজরা,নামা,কুলো,পিছা,টোকরা,চ্যাঙারি।চোখ রাখলে পাওয়া যায় লুপ্ত প্রায় তালপাতার চেটা,চ্যাটাই,পেখে। বিক্রি হয় লোহার হাতা,খুন্তি,দা,নিড়েন,কোদাল, দাউলি, ইত্যাদি।বড় বড় জিলিপি মেলার বড় পাওনা।এই সবকে ছাপিয়ে মেলায় বিক্রি হয় ঝুড়ি ঝুড়ি কাঁকড়া।রাশি রাশি কাঁকড়া।পেটি পেটি কাঁকড়া।আরে বাবা! ‘কেঁকো পোকা’ (গ্ৰাম্য কাঁকড়ার বাচ্চা) বা চিতি কাঁকড়া নয়।এ সবই সামদ্রিক কাঁকড়া।ক্যানিং, রায়দিঘি, এবং সুন্দরবন থেকে আসে এই সব ইয়া বড় বড় কাঁকড়ার দল।কোনটা দু’শো- পাঁচশো।কোনটা এক কেজি – দেড় কেজি।এমনকি দুকেজি ওজনের কাঁকড়াও দেখা যায় আকর্ষণীয় এই কাঁকড়া মেলায়। লোভনীয় এই কাঁকড়ার দাম কম নয়।মত শ তত দাম। কাঁকড়া কেনার পড়ে যায় হুড়োহুড়ি।বড় মাপের কাঁকড়া এলে হয় নীলাভ। কাঁকড়া কেনার ও তাকে তৃপ্তি করে খাওয়া এই মেলার ঐতিহ্য। কাঁকড়া চাই।তাই মেলা অধিক জনপ্রিয় ‘কাঁকড়া’ মেলা নামে।কাঁকড়ার পাশাপাশি এই মেলায় বিক্রি হয় ডাবা ডাবা আলুর দম।হাড়ি হাড়ি আলুর দম।তেল ঝাল থাক বা না থাক , মেলাপ্রমীদের মুড়ি আলুর দম চাই-ই-চাই। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাঠে মাদুর পেতে , কেউ বা চেটাই পেতে খদ্দের আপ্যায়ন করেন। এখানে আলুর দম বিক্রি হয় কেজি দরে।তাই কেউ বলে ‘আলুর দম’ মেলা।হিন্দু মুসলিমের মিলনক্ষেত্র , বলা ভালো সম্প্রীতির এই মেলা শুরু হয় পয়লা মাঘ ভোর থেকেই। মেলা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। একদিনের মেলায় লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি , হাওড়াতো বটেই বাংলার বৃহত্তম মেলা বলা যেতে পারে।হাওড়া বা কলকাতা থেকে আমতা বা রাজাপুর। রাজাপুরের কাছেই সিংটি মোড়।এখান থেকেই শোনা যায় মেলার হাঁকডাক। কাঁকড়ার কড়কড়ানি।আলুর দমের গন্ধ।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

1,231FansLike
10FollowersFollow
4SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles